পূর্ব প্রকাশিতের পর
‘‘সাধু জিহ্বায় সংবরো’’–ঠিক তেমনই খাবার লোভ সংবরণ করতে হবে, জিহ্বার ওপর, রসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে৷ ধর, কারও পেট খারাপ হয়েছে, তাকে তো আর কাঁটাল খেলে চলবে না৷ ভেবে দেখতে হবে, খাওয়ার ফলাফলটা ভাল হবে না মন্দ হবে৷ দেখবে, অনেক লোক ডিস্পেপ্সিয়া, গ্যাসট্রিক আলসার ইত্যাদি পেটের রোগে ভুগছে৷ খোঁজ নিয়ে দেখবে, অধিকাংশ সময় ওদের খাদ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ একেবারে ছিল না৷ যখন যা পেয়েছে তা–ই খেয়েছে৷ লোকে বলে, পরের পয়সায় পাই তো টিংকচার আয়োডিনও খাই৷ এই অবস্থায় ‘‘সাধু জিহ্বায় সংবরো’’৷ ‘‘কায়েন সংবরো সাধু, সাধু বাচায় সংবরো’’৷ শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখ৷ কারুর সঙ্গে মতভেদ হ’ল আর সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, অথবা বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে, সেটা ঠিক নয়৷ হতে পারে তোমারই দোষ৷ তুমি ভেবে–চিন্তে তারপর তার ওপর শারীরিক শক্তির ব্যবহার কর৷ ‘‘সাধু বাচায় সংবরো’’ ঃ ঠিক তেমনই কথা বলবার আগে ভেবে দেখ কোন্ কথাটার ফল কী রকম হবে৷ যা মুখে এল তা–ই বলে দিলে তা তো ঠিক নয়৷ বাক্যের ওপর সংযম রাখ৷ ‘‘সব্বত্থ সংবরো ভিক্খু সব্ব দুখ্খৈ পমুচ্যতে’’৷ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যদি এইরকম সংযম অভ্যাস কর তাহলে তোমাকে দুঃখভোগ করতে হবে না৷
আর চতুর্থ হ’ল চরিত্র৷ সমস্ত ক্রিয়ার সামূহিক নাম চরিত্র৷ একটা মানুষ কীভাবে খাচ্ছে, কীভাবে চলছে, তার যে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া, সেই ক্রিয়াগুলোর মিলিত নাম হ’ল চরিত্র অর্থাৎ অনেকগুলো আচরণের সমষ্টিকে বলা হয় চরিত্র৷ ‘চর্’ ধাতু+ল্যুট=চরণ আ–চর+ল্যুট=আচরণ৷ আচরণ মানে চলা–বিভিন্ন ধরনের চলা৷ হাতকে যেভাবে চালাচ্ছ সেটাও একটা আচরণ৷ হাত চালানোকে সংস্কৃতে বলা হয় ‘শিল্পন’৷ হাত দিয়ে ভাল করে যে ছবি আঁকল, মূর্ত্তি গড়ল সে হ’ল শিল্পী৷ যে ভাল গান গাইল তাকে শিল্পী বলা যায় না কারণ গানটা তো হাত দিয়ে গায় না, কণ্ঠ দিয়ে গায়৷ তাই সঙ্গীত–শিল্পী হয় না৷ হাতের কাজকে বলা হয় শিল্প৷ লোকে বলে কণ্ঠশিল্পী, ভাল শিল্পী৷ সেটা ঠিক নয়৷
বিভিন্ন আচরণের সমষ্টি হ’ল চরিত্র৷ এখন দেখতে হবে, ‘চরণ’ মানে কী? ‘চরণ হ’ল যে, কোন কাজ হয়ে চলেছে ও সেই কাজের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক খাদ্যও তেমনই পেয়ে চলেছে, তবেই সেটা চরণের পর্যায়ভুক্ত, নইলে নয়৷ মনে কর, তুমি একটা কাজ করছ আর কাজের বিনিময়ে তুমি মনে মনে আনন্দও পাচ্ছ, মনের একটা খাদ্য পাচ্ছ, তবেই সেটা হ’ল তোমার চরণ ক্রিয়া৷ কিন্তু ধরো, কেউ জোর করে তোমায় দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে, গাধার খাটুনি খাটাচ্ছে, সেটা তখন চরণ ক্রিয়া নয়, কারণ তার বিনিময়ে তুমি মনের কোন খাদ্য তো পাচ্ছ না, অবস্থার চাপে পড়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছ৷ গোরু যখন চলে তখন সে খেতে খেতে চলে, তাই সেটা তার চরণ ক্রিয়া৷ আমরা তাই বলি, গোরু চরছে৷ আর মানুষ যখন চলে তাকে আমরা চরণ বলি না, চলন বলি কারণ চলবার সময় সে তো খায় না৷ কিন্তু ধরো কোন মানুষ চীনেবাদাম খেতে খেতে যাচ্ছে তখন সে চরছে৷ হ্যাঁ, এই যে বিভিন্ন ধরনের চরণ ক্রিয়া তার সমষ্টিকে বলা হয় চরিত্র৷ একটা মানুষ যেভাবে খায়, যেভাবে কথা বলে, যেভাবে চলে, বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে যেভাবে ব্যবহার করে, যে ভাবে তাকায়, যেভাবে শোণে–এই সব কিছুর সমষ্টি হ’ল তার চরিত্র৷
তোমরা জেনে রাখবে, একটা মানুষগোষ্ঠীর জীবনের যে বিভিন্ন অভিব্যক্তি, সেগুলোর মিলিত নাম হ’ল সংসৃক্তি৷ আর বিভিন্ন ব্যষ্টির বিভিন্ন আচরণের সমষ্টিকে বলব চরিত্র৷ এইজন্যে বলা হয় ক্ষাঙালীর জাতীয় চরিত্র৷ ব্যষ্টিগত জীবনে এই ‘চ’ হবে কীরকম? এই ধরনের আচরণীয় অভিব্যক্তি ঘটছে, কারুর সঙ্গে কথা বলছ বা যাই কর না কেন, সেই সময় নজর রাখতে হবে আচরণটা ঠিক হচ্ছে তো এই ধরনের নজর থাকলেই সমস্ত আচরণের যে সমষ্টি বা চরিত্র, সেটার ওপর তোমার কন্ড্রোল বা নিয়ন্ত্রণ থাকবে৷ আর এই যে আচরণের সমষ্টি, এর দিকে নজর রাখতে রাখতে এগুলো যখন ক্রমশঃ উন্নত হতে থাকবে তখনই বলব তার চারিত্রিক উন্নতি হচ্ছে৷ এই করতে করতে যখন একটা স্বভাবে দাঁড়াবে, যখন সে বলবে–না, আর আমি এরকম করব না, আমি দু’হাত দিয়ে এমন করে খাব না, আমি এক হাতেই খাব আর হাত ধুয়েই খাব, এইরকম করতে করতে আর কেউ বললেও তখন শুণছেনা তখন একটা আচরণীয় দৃঢ়তা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে–সেইটাকে বলি চারিত্রিক দৃঢ়তা৷ ‘এইটা আমার নীতি, আমি এর থেকে সরব না এটা আমার আদর্শ, আমি এর থেকে এক চুলও নড়ব না এটা খাওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই উপকারী নয়, এটা আদর্শবিরোধী কাজ–এই সমস্ত ব্যাপারে যে শক্তভাবে টিকে রইল, এই দৃঢ়তা যখন কারো মধ্যে এসে গেল, তখনই সেটাকে বলব চারিত্রিক দৃঢ়তা৷ এটা অর্জন না করলে বড় কাজ করা যায় না৷ এযাবৎ তোমরা হয়তো জানতে, ‘চরিত্র’ শব্দটা একটা বিশেষ সীমিত অর্থে ব্যবহূত হয়৷ কিন্তু এটাকে একটা সীমিত অর্থে না রেখে তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করতে হবে৷ আচরণের সমষ্টির ক্ষেত্রে এই চারিত্রিক দৃঢ়তা অর্জন করতে গেলে সব সময় জিনিসটায় নজরও রাখতে হবে৷ আমি যে এই কাজটা করছি এটাতে আমার দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে কিনা৷ শত্রুর সঙ্গে লড়াই হচ্ছে, শত্রুপক্ষের কেউ এসে বললে–এই নাও তুমি বিশ হাজার টাকা, তলে তলে আমাকে সাপোর্ট করো এই ধরনের প্রস্তাবে সায় দিয়ে টাকা নেওয়া হলে তা হবে চারিত্রিক অধঃপতন, কারণ এটা খারাপ আচরণ৷ সামগ্রিক চরিত্রটা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল৷ তাই প্রতিটি কাজের সময় দেখতে হবে এতে আমার চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে তো৷ ‘চ’ অর্থে এতটা ক্ষোঝায়৷
গায়ত্রী মন্ত্রের একটা নিয়ম আছে৷ ওর কিছুটা অংশ হ’ল ঃ–
‘‘ওং ভুর্ভুবঃ স্বঃ৷
ওং তৎসবিতুর্বরেণ্যম্৷
ভর্গো দেবস্য ধীমহি৷
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওং৷’’
এটা ব্যক্ত গায়ত্রী৷ প্রত্যেক মানুষের যেটা ইষ্টমন্ত্র, সেই ইষ্টমন্ত্রটা তার শ্বাস–প্রশ্বাসের সঙ্গে ছন্দিত হয়ে যায়৷ ক্রমাগত অভ্যাসের ফলেই সেটা হয়৷ যখন ঘুমোচ্ছে তখনও তার মন্ত্রজপ আপনা থেকেই চলছে৷ সেই অবস্থাটাকে বলে গুপ্ত গায়ত্রী৷ সেই গুপ্ত গায়ত্রীর অবস্থা যখন জীবনে আসে তখন আর মুখে কোন অবস্থাতেই ইষ্টমন্ত্রটা বার করা উচিত নয়৷ যেখানে তুমি একলা রয়েছ, আর কেউ শোণবার নেই, সেখানেও নয়৷ গুপ্ত গায়ত্রী গুপ্তই থাকে৷ ঠিক তেমনই ‘ভবিস্চ’ শব্দটা ব্যষ্টিগত জীবনে গুপ্ত গায়ত্রীর মত ব্যবহার কোরো৷ দেখবে, এটা সদ্য ফলপ্রদ৷ সঙ্গে সঙ্গে ফল পাবে৷