দুর্নীতি শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়৷ ভারতবর্ষের কোন রাজনৈতিক দলই দুর্নীতিমুক্ত নয়৷ আজ দুর্নীতি ও নানা হল্লাবাজির আড়ালে একটা ন্যায় সঙ্গত প্রশ্ণ বারবার কোটি কোটি হতভাগ্য মানুষের সামনে আসছে তা হলো কেন মুষ্টিমেয় ধনী ব্যষ্টি যারা ভারতের মতো বিশাল দেশের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করে বছরের পর বছর তাদের শোষণ ও বঞ্চনা করে চলেছে, এদেরই সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত রয়েছে সারা ভারতের শাসক গোষ্ঠী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা৷ তারই নির্মম পরিণতি হলো সারা ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি৷ যত কেলেঙ্কারী দেশের খনিজ, বনজ, শিল্পজ সম্পদ ও জমি নিয়ে আর সব কিছুর ভক্ষক হচ্ছে ওরাই৷ বর্ত্তমানে ভারতে যে গণতন্ত্র চলছে রাজনীতির আড়ালে, এটা সেই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একটা ভয়ঙ্কর শোষণেরই যন্ত্রবিশেষ৷ অদ্যাবধি কোন সরকার সাধারণ মানুষের ক্রয়–ক্ষমতা কিভাবে বাড়বে, তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে সেদিকে যতটা দৃষ্টি দেওয়ার কথা তাতো দেয়ই নি বরং ছল চাতুরী করে তাদের শোষণই করছে৷ বেকার সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বস্ত্র সমস্যা, মাথা গোঁজার সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা, রোগে ওষুধ পাওয়ার সমস্যা, এমনকি জাত–পাতের সমস্যাকে সমাধান করে মানুষের মনে একটু আশার আলো জাগাবার কোন ব্যবস্থাই নেই৷ দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে৷ দেশসেবক আজ আর পাওয়া যায় না৷ আজ পঞ্চায়েৎ স্তর হতে নানা দলের রাজনৈতিক নেতা–নেত্রীরা দেশ শাসনের নামে নির্মমভাবে শোষণ করে চলেছে৷ গ্রামগুলিকে কৃষি উন্নয়নে ও কৃষি ভিত্তিক, কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তোলার সামান্যতম কাজ না করে শাসকবর্গ ধনীদের আশ্রয়ে গিয়ে তাদের পকেটভর্ত্তি করে চলেছে৷ গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট কুটির শিল্প গড়তে হবে৷ গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও ছোট ছোট শিল্পের মাধ্যমে যেখানে কাজ করবে গ্রামের ছেলেমেয়েরা৷ শ্রমিকরাই হবে সমবায়গুলির অংশীদার৷ মালিক আর শ্রমিকদের পার্থক্যটা ধীরে ধীরে দূর করতে হবে৷ সবাই হবে শিল্প–কলকারখানার অংশীদার৷ তবে তো শোষণ বন্ধ হবে৷ ভালাবাসা ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক তথা আর্থিক উন্নতি ঘটবে৷ ভারতের সার্থক সভ্যতাই হলো গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ৷ তাকে বিজ্ঞানের সহায়তায় ধীরে ধীরে উন্নত করে তুলতে হবে৷ সেদিকে অদ্যাবধি সরকার কি কেন্দ্র কি রাজ্য তো নজর দেয়নি?
সর্বদাই দেখা যাচ্ছে দেশের বাইরের ধনীদের আর্থিক অনুগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে, শিল্পে উন্নতির দিকে নজর দিতে গিয়ে দেশ হুমড়ী খেয়ে পড়ছে৷ দেশের শিল্পপতিরা তো দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে৷ তাদের সঙ্গে সর্বনাশের পথ প্রশস্থকরছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী৷ বিড়লা ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দমোটরস্–কে ধ্বংস করে দিয়েছে৷ ৭৫০ একর জমি লীজ নেয়৷ তার মধ্যে সংবাদে প্রকাশ ৩৫০ একর বামফ্রন্টের আমলে কয়েকশ’ কোটি টাকায় সরকারের সহায়তায় বিক্রি করে দেয় কারখানার উন্নতির জন্য৷ কিন্তু কারখানার উন্নতি না করে টাকা সরিয়ে নেয়৷ কারখানাতে তালা ঝুলিয়ে শ্রমিকদের বেতন আটকে দিয়ে লক্ষাধিক লোকের জীবিকা বরবাদ করে৷ এ কাজে খোদ কমিউনিষ্ট মার্কস্বাদী সরকার যুক্ত ছিল৷ যারা শ্রমিকবন্ধু হিসাবে চিৎকার করত৷ আবার এদিকে টাটা সিঙ্গুরের মত ৪ ফসলি জমি ১০০০ একর লীজ নেয়৷ এতো জমি নেওয়ার দরকার ছিল না৷ ন্যানো গাড়ি করার জন্য টাটা এগিয়ে আসে বুদ্ধদেব–এর শাসনকালে৷ তৃণমূলের নেত্রী মমতা আন্দোলন করে সিঙ্গুর–এর চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে একটা তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বামফ্রন্টকে উৎখাত করে দেন পরবর্তীতে মহামান্য আদালতের রায় চাষীরা তাদের জমি ফেরৎ পান কিন্তু তার বেশিরভাগটাই চাষযোগ্য নেই৷
সিঙ্গুর আজ সমস্যায় ভুগছে পুঁজিবাদের তোষণকারী বাম শাসকের খামখেয়ালীপনায়৷ শাসক চলে গেছে কিন্তু চাষীর দুর্দশা কি দূর হয়েছে? হুগলীর সিঙ্গুরের অতি ঊর্বর জমি আলু, ধান, সরষে, শাকসব্জির উন্নতমানের ফসলে ভরে থাকতো, চাষীরা চাষের ফসল ফলিয়ে পরিবার চালাতো৷ তাদেরকে পথে বসিয়ে পুঁজিপতির হাতে জমি তুলে দিতে চেয়েছিল শ্রমদরদী সরকার এ কেমন গরিবের সরকাব ছিল? কৃষি প্রধান দেশকে ধবংস করে সর্বহারার তকমা গায়ে লাগিয়ে ধনীর উদর পূর্ত্তির চেষ্টা এর পশ্চাতে তো দলীয় স্বার্থ কাজ করেছে৷ আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিৎকার করছে৷ ৩৪ বছর যারা দুর্নীতির পাহাড়ে বসে রাজ্য শাসন করেছে৷
এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এমনই পুঁজিপতি অক্টোপাশের দ্বারা আবদ্ধ তাদের পক্ষে গরিবের চোখের জল মোছানো সম্ভব নয়৷ কারণ তাদের দল বাঁচবে না যদি ধনীর কৃপাদৃষ্টি তাদের উপর না পড়ে৷
তাই জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গণ আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে হবে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আজ সব কিছুকে গ্রাস করছে৷ আজ দুর্নীতি শুধু একটা দুটো নেতা মন্ত্রী নয়, রাজনৈতিক দল, আমলা , প্রশাসন এমনকি গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগ ও মিডিয়ার গায়েও কালিমাখাচ্ছে৷ দুর্নীতিগ্রস্ত স্টেট ক্যাপিট্যালিজমের ঔদ্ধত্য ও মার্কসবাদ সারা বিশ্বে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে৷ আজ তাই ক্যাপিট্যালিজম্ আর কমিউনিজমের মধ্যে তফাৎ নেই৷ তারা দুজনেই শোষক৷ মনে রাখা দরকার গণতন্ত্র বাঁচবে তখন যখন সমবায় আন্দোলনে জনগণের ক্রয় ক্ষমতাকে বাড়াতে সক্ষম হবে৷ যে নাগরিকগণ বেকার, খেতে পায় না – তাদের রাজনৈতিক অধিকার তো একটা প্রহসন৷
গণতান্ত্রিক পথে তাই গণর্থনীতিকে জনগণের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার পথে সরকারকে ধীরে ধীরে এগুতেই হবে নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্র এক প্রহসনে দাঁড়াবে৷ এব্যাপারে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউটই (প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব) সমাধানের পথ দেখাতে সক্ষম৷ প্রাউট অর্থনীতির মূল কথা কেন্দ্রীত অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে নোতুন করে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে৷ যার দায়িত্বে থাকবে এক একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ৷ সেখানে কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থান করতে হবে ও প্রতিটি মানুষের হাতে ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ এইভাবে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের হাতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তুলে দিতে হবে৷ তবেই গণতন্ত্র সার্থক হবে৷
- Log in to post comments