স্বাধীনতার পর ৭৩ বছর অতিক্রান্ত৷ কিন্তু আজও দেশীয় ফ্যাসিষ্ট পুঁজিপতি ও তাদের পোষ্য রাজনৈতিক নেতাদের নেতাজী আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ একটা কথা পরিস্কার---১৯৪৫ সালের ১৮ই আগষ্ট তাইহোকু বিমানবন্দরে কোনও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি৷ সুতরাং ওই দিন বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু একটি আষাঢ়ে গল্প মাত্র৷ তাইওয়ান সরকারও নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য উদ্ঘাটনে গঠিত মুখার্জী তদন্ত কমিশনের কাছে জানিয়েছেন ওই দিন তাইহোকুতে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি৷ ভারত সরকারের হাতে আজ পর্যন্ত এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই যে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী মারা গেছেন৷
তবু ভারত সরকার গত ৭৩ বছর ধরে একটার পর একটা তদন্তের নাটক করেছে আর নেতাজীকে মৃত প্রমাণ করতে চেয়েছে কোন প্রামাণ্য নথিপত্র ছাড়াই৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর অবদান, তাঁর আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, আদর্শবোধ কোনও বিষয়েই নেতাজীর ধারেকাছে ছিল না তৎকালীন তাবড় দেশপ্রেমিক নেতারা৷ সে তিনি যত বড় মহাত্মাই হোন আর যত উচ্চ স্ট্যাচু হোন৷ ভারত সরকারের হেফাজতে থাকা নেতাজী সংক্রান্ত গোপন নথিও ভারত সরকার প্রকাশ করছেন না৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল---নেতাজী সংক্রান্ত সব গোপন নথি প্রকাশ্যে আনবেন৷ অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে না রাখাটাই ভারতীয় নেতাদের স্বভাব৷ নরেন্দ্র মোদীও এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম নন৷ তাই নেতাজী সংক্রান্ত গোপন নথি আজও প্রকাশ্যে আসে নি৷ বিরোধী দলগুলো এ বিষয়ে নীরব৷ আসলে নেতাজী সংক্রান্ত বিষয়ে ডান-বাম-রাম সব পক্ষ একপক্ষ হয়ে যায়৷ এই সব পক্ষেরই টিঁকি বাধা আছে দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে৷ তাই নেতাজীকে জনমন থেকে মুছে দেবার অনেক চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু সেটা সম্ভব না হওয়াতে নেতাজীকে যে কোন ভাবে মৃত ঘোষণা করে সাধারণ একজন দেশনেতার পরিচয়ে ইতিহাসে স্থান দেওয়ার চক্রান্ত চলছে৷ সেই চক্রান্তেরই স্বরূপ ফুটে উঠল ১৮ই আগষ্ট যখন কংগ্রেস-বিজেপি মিলিতভাবেই নেতাজীর মৃত্যু দিবস পালন করে৷
নেতাজীকে নিয়ে এত আতঙ্ক এত ভয় কেন? ভয় দেশীয় পুঁজিপতিদের৷ ভয় তাদের অর্থে পুষ্ট ও পোষ্য রাজনৈতিক নেতাদের৷ ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে এক ভাষণে বলেছিলেন---‘‘দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তি অর্জন করছে৷ আমাদের এদের বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ জনগণকে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিলেই হবে না, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷’ কি মারাত্মক কথা! গান্ধী সুভাষ নীতিগত বিরোধ ছিল৷ সুভাষচন্দ্র এই কথাগুলো বলা মানে আগুনে ঘি ঢালা৷ ব্যাপারটা তাই হ’ল৷ যে কংগ্রেস দলটাই পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্যে, সেই দলের সভাপতির মুখে একী কথা! গান্ধীকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনার উদ্দেশ্যই ছিল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ যাতে পুঁজিপতিদের হাতের বাইরে না যায়৷ একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে শক্তি যোগান, অপরদিকে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণও হাতে রাখা---এই দ্বিচারী ভূমিকা ছিল সেদিনের দেশীয় পুঁজিপতিদের৷ গান্ধী ছিলেন এই দুইয়ের মাঝে সেতু হয়ে৷ সেখানে কংগ্রেস সভাপতির মুখে পুঁজিপতি বিরোধী কথা! শুধু বিরোধিতাই নয়, দেশীয় পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীকে শক্তি যোগানোর অভিযোগ৷ এ হেন বিপজ্জনক লোককে কংগ্রেসে রাখা যায় না৷
দেখতে খেতে অনেক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে একটা বছর অতিক্রান্ত হ’ল৷ ১৯৩৯ সাল ---৷ আবার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের সময় এসে গেল৷ না, সুভাষকে আর কংগ্রেস সভাপতি করা যাবে না৷ কারণ এতো শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শত্রু নয়, দেশীয় পুঁজিপতি ও তাদের অর্থে পুষ্ট ও পোষ্য দেশনেতাদের কাছেও বিপজ্জনক৷ এ হেন মানুষটিকে কিছুতেই দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি করা যায় না৷ সুভাষ ও তাঁর অনুগামীরাও অনড়৷ সুভাষকেই দ্বিতীয়বারের জন্যে কংগ্রেস সভাপতি করতে হবে৷ অপরদিকে গান্ধী ও তাঁর পক্ষের লোকেরা মানতে নারাজ৷ তাই কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে গান্ধী মনোনীত প্রার্থী হলেন পট্টভি সীতারামাইয়া৷ গান্ধীর অমতে সুভাষচন্দ্র প্রার্থী হলেন ও গান্ধী মনোনীত পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে জয়ী হন৷ গণতন্ত্রকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার করলেও হিন্দী বলয়ের মানুষ কোনদিনই গণতন্ত্রকে মর্যাদা দেয়নি৷ তাই সুভাষচন্দ্র যাতে সভাপতি হয়ে কাজ না করতে পারে, যাতে লোকটা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয় তার জন্যে গান্ধী-নেহেরু-পটেল ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা নানা চক্রান্ত ও অসৎ উপায় অবলম্বন করলেন৷ দেশীয় পুঁজিপতিদের মদত তো ছিলই৷ তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আবেদনও সে চক্রান্ত থামাতে পারেনি৷ কংগ্রেসে অশুভ শক্তিরই জয় হ’ল৷ সেদিন শুধু কংগ্রেসই নয়, পুঁজিপতিদের প্রধান পৃষ্ঠকোষক আর.এস.এস. তো সুভাষের বিরুদ্ধে ছিলই, এমনকি কমিউনিষ্টরাও সুভাষচন্দ্রের পাশে থাকেনি৷
পরের ইতিহাস কিছুটা আবছা, বাকিটা অজ্ঞাত৷ আবছা ব্রিটিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব হাতে নেওয়া, আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই৷ বাকীটা প্রচার-অপপ্রচারের কল্পিত কাহিনী৷ তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেতাজীর শেষ পরিণতি পুরোটাই অজ্ঞাত৷ বিমান দুর্ঘটনা একটা আষাঢ়ে গল্প মাত্র৷ দুঃখের বিষয় দেশের এতবড় একজন দেশপ্রেমিক নেতার শেষ জীবনে কী ঘটল, তিয়াত্তর বছরের একটা স্বাধীন দেশের সরকার সেই সত্যকে সামনে আনতে পারল না৷ আসলে সামনে আনার সৎ সাহস দেখাল না৷ তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা আষাড়ে গল্প হলেও রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে ১২২ বছর বেঁচে থাকাটাও অসম্ভব৷ তবু তাঁকে নিয়ে এত আতঙ্ক, এত মিথ্যাচাব কেন? জয় তো অশুভ শক্তিরই হয়েছে৷ সুভাষচন্দ্রকে উৎখাত করে, দেশ ভাগ করে, বাঙলাকে সব দিক দিয়েই নিঃস্ব করে দেশীয় পুঁজিপতিদের পোষ্য হয়ে নেতা মন্ত্রীদের ভালই কাটছে৷ এই একটি ক্ষেত্রে বাম, কংগ্রেস, বিজেপি সবাই এক৷ ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে এরাই জয়ী৷ তবু ভয় এদের যায় না৷ কারণ অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, যে ইতিহাস কালাাধারের কবরে ঘুমিয়ে আছে৷ সেই ইতিহাস যদি সামনে আসে অতীত যদি আবার জেগে ওঠে, বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্ত্তিও ধূলায় মিশে যাবে৷ কোন কোন মহাত্মারও দূরাত্মার স্বরূপটা প্রকাশ হয়ে যাবে৷ চচার চরিত্রও উদ্ঘাটিত হবে৷ অনেক দেশপ্রেমিকের মুখোশ খসে পড়বে৷ তথাকথিত বামপন্থার সাম্রাজ্যবাদী তোষণের ইতিহাসটাও আর গোপন থাকবে না৷ এই অনেক কারণেই নেতাজী রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি৷
পৃথিবীতে অনেক রকমই মুর্খ আছে৷ হস্তিমুর্খ, আকাট মুখ, নিরটে মুর্খ, আস্ত মুর্খ.........৷ স্বদেশীয়ানার মুখোশধারী ভারতীয় দেশনেতারা শশক মুর্খ৷ শশক যেমন গর্তে শুধু মুখটা ঢুকিয়ে ভাবে অন্ধকারে লুকিয়ে গেছি, তেমনি সুভাষ আতঙ্কে আতঙ্কিত ভণ্ড দেশনেতারা ভাবে একবার যদি সুভাষচন্দ্রকে মৃত প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে সব সত্য হারিয়ে যাবে অতীতের গহ্বরে৷ ভণ্ড নেতারা বোঝে না ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না৷ সত্য একদিন সামনে আসবেই৷
- Log in to post comments