‘কামময়’ কোষের পরিশোধনে ‘চরম নির্দেশ’-এর ভূমিকা

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ  ভৌমিক

 

‘কামময়’ কোষের পরিশোধনের জন্য ‘চরম নির্দেশ’-এর কি ভূমিকা বা ‘চরম নির্দেশ’ কতখানি প্রেরণা দিতে পারে তা বুঝতে হ’লে সর্বপ্রথমে আমাদের ‘নৈতিকতা’ বাMorality সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান নিতে হবে৷ ‘ৰাৰা’ (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী) বলেছেন--- সাধনার ভিত্তিভূমি হ’ল ‘নৈতিকতা’৷ এই নৈতিকতা ছাড়া অর্থাৎ নৈতিকতাকে এড়িয়ে বা বাদ দিয়ে সাধনার প্রথম ধাপ অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রণিধানের প্রতি মনোনিবেশ করা অসম্ভব৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করার ঠিক এই প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সাম্যের প্রয়োজন সেটাকেই বলা হয় নৈতিকতা৷ Morality)

আমরা জানি যে, কামময় কোষ মূলাধারচক্রে অবস্থান করে ও এখানে অবস্থান ক’রে জাগতিক জগতের ভোগের প্রবল বাসনাকে উদ্দীপ্ত করে৷ কামময় কোষের স্বভাব অনুযায়ী মনকে ভোগের মধ্যে তীব্রভাবে লিপ্ত রাখে৷ ফলে এই ভোগের প্রবল আকর্ষনে পড়ে গিয়ে সাধক তার সাধনায় মনোনিবেশ করার সুযোগ করে উঠতে পারে না৷ জাগতিক জগতের ভোগের তীব্র আকর্ষন আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে পরমপুরুষের প্রতি যে টান তা হারিয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে, প্রতি মুহূর্তেই নিজের অন্তঃস্থ বিরোধী ভাবগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাইরের এই জাগতিক আকর্ষনের প্রলোভনকে সাম্য equiliberum) অবস্থায় রাখতে হবে৷ নতুবা অন্তরের অসাম্য জাগতিক বা বাইরের প্রলোভনে পড়ে গুরুতর রূপ ধারন করলে তা মানসিক বিকৃতি উগ্রভাবে দেখা দিতে পারে৷

এই মানসিক বিকৃতিটাই সাধনা পথে হ’য়ে ওঠে চরম বাধা৷ ফলে সাধনার প্রথম লেসনে (ঈশ্বর প্রণিধান) মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না৷ কামময় কোষের এই যে আকর্ষন এটাই হ’ল এই কোষের মলিনতা৷ সুতরাং এই কোষের মলিনতা শোধন না করলে সাধনার প্রথম ধাপেই সাধক হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে৷ কামময় কোষের এই জাগতিক জগতের প্রলোভন বা মলিনতাকে সরাতে হবে৷ জাগতিক জগতের এই মলিনতাকে দূর করার জন্য ‘ৰাৰা’ বলেছেন---‘যম ও নিয়ম’ কঠোরভাবে পালন করলে তবেই কামময় কোষের মলিনতা দূরিভূত হবে৷ সুতরাং ‘নীতিবাদ’ সাধনা মার্গের যাত্রা পথে প্রারম্ভ-বিন্দু৷ নীতিবাদ হ’ল সৎনাগরিকের লক্ষ্মণ৷

মানব জীবনে নীতিবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার৷ একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া অর্থাৎmoralist হওয়া সাধকের জীবনের চরম লক্ষ্য বা আদর্শ নয়৷ চরম লক্ষ্য হ’ল ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তি৷ আর এই ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তির জন্য নৈতিকতা বা নীতিবাদী মনই সাধককে তার ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তিতে সাহায্য করে৷ তাই নৈতিকতা ছাড়া সাধনা অসম্ভব৷ কোন সাধকের মনে টাকা পয়সা বা বিষয় সম্পত্তি ভোগের প্রবল আকর্ষন অথবা চুরি করার ইচ্ছা, এমনিই জাগতিক ভোগের আকর্ষনগুলোর টানে ঐ সাধকের ব্রহ্মের প্রতি আকর্ষনকে ভেঙে চুরমার করে দেবে৷ চুরি না করাই মানুষের জীবনে শেষ কথা নয়, চুরি করার প্রবৃত্তিটাও মন থেকে বিদূরিত হওয়া সব চাইতে বড় কথা৷

তাই এই কামময় কোষের মলিনতাকে দূর করার জন্য ‘ৰাৰা’ কৃপা করে আমাদের জন্য দিয়েছেন---‘যম নিয়ম’৷ শুধুমাত্র ‘যম-নিয়ম’ দিয়েছেন তাই না, যাতে আমরা ‘যম-নিয়ম’ পালনের কথা ভূলে না যাই অথবা ‘যম-নিয়ম’ পালনের প্রতি কোন অবহেলা বা দুর্বলতা না আসে তার জন্য প্রতি সপ্তাহে সাধনার শেষে স্মরনিকা হিসাবে চরম নির্দেশ Supreme command) পাঠের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা ‘ৰাৰা’ করে দিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়, যম-নিয়ম কি, তার পুঙ্খানু পুঙ্খানু ব্যাখ্যা এবং কিভাবে আমরা যম-নিয়ম মেনে চলব তারই জন্য ‘জীবন বেদ’ নামক বইটি ‘ৰাৰা’ লিখে গিয়েছিলেন৷ এটা আমাদের উপর তথা সমগ্র মানব সমাজের প্রতি তাঁর অহৈতুকী কৃপা ছাড়া আর কিছুই নয়৷  সুতরাং এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পাচ্ছি, এই চরম নির্দেশের মধ্যেই রয়েছে সাধনার প্রথম ধাপ--- ঈশ্বর প্রণিধানের নির্দেশনা৷ যম-নিয়ম প্রসঙ্গে ‘ৰাৰা’-র আরও কিছু কথা হ’ল ---‘‘অষ্টাঙ্গ যোগের প্রথম যম-সাধনার পাঁচটি অঙ্গের মধ্যে ব্রহ্মচর্যের শ্রেষ্ঠতা অধিক, আর নিয়ম-সাধনার সব চাইতে বেশী মাহাত্ম্য ঈশ্বর প্রণিধানের৷ যম-নিয়মের দশটি অঙ্গের মধ্যে আটটি অঙ্গ বাকী দুটি অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য ও ঈশ্বর প্রণিধানেরই সাধনাঙ্গ৷ বৈশিষ্ট্যগত বিচারে যম সাধনা হচ্ছে মূলতঃ লৌকিক ও মানসিক জগতের সাধনা, আর নিয়ম- সাধনা লৌকিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ৷’’ ‘‘নীতিজ্ঞান বর্জিত মানুষ, মানুষ নামের অযোগ্য৷’’ এই চরম নির্দেশের গুরুত্বের কথা নোতুন করে পাঠকগণ যেন ভাবেন, পাঠকগণের কাছে এটা আমার বিশেষ নিবেদন৷