১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল৷ গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে বোধকরি সবচেয়ে পৈশাচিকতম ঘটনা ঘটে গেল আজকের সভ্যতার পীঠভূমি কলকাতার বিজন সেতু ও বণ্ডেল গেটের মত জনাকীর্ণ এলাকায়৷ প্রকাশ্য দিবালোকে৷ আনন্দমার্গের ১৬জন সন্ন্যাসী ও ১জন সন্ন্যাসিনীকে বর্ণনার অতীত নৃশংসতম ভাবে খুন করল তৎকালীন শাসকদল সিপিএম’এর গুণ্ডাবাহিনী৷ পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল৷ স্পষ্টই বোঝা যায় এই হত্যার ষড়যন্ত্র একেবারে ওপর মহল থেকেই করা হয়েছিল৷
তৎকালীন অবিভক্ত ২৪পরগণার অতিরিক্ত জেলাশাসক শের সিং আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন, এই ঘটনার পেছনে ‘‘রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিটি’ জড়িত ছিলেন’’৷ ‘রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিটি’ মানে স্বনামধন্য জ্যোতি বসু৷ এই জ্যোতি বসুর অ৷লি হেলনে সাঁইবাড়ী হত্যাকাণ্ড, মরিচ ঝাঁপি বাঙালী নিধন যজ্ঞ প্রভৃতি বহু ঐতিহাসিক গণহত্যা ঘটেছিল৷
কিন্তু প্রশ্ণ উঠতে পারে, আনন্দমার্গ একটি আধ্যাত্মিক সমাজসেবামূলক সংস্থা৷ এর বিরুদ্ধে সিপিএম বার বার নৃশংসভাবে আক্রমণ হানতে গেল কেন?
তার কারণ, আনন্দমার্গের অভ্যুত্থানে সিপিএম তাদের মৃত্যুর ঘণ্ঢাধ্বনি শুণতে পেয়েছিল৷ কেন? তার প্রধান কারণ, আনন্দমার্গ কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তি–মোক্ষের কথাই বলেনি, আনন্দমার্গ এমন এক সর্বা৷সুন্দর সমাজগড়ার কথা বলেছে যেখানে কোনো প্রকার শোষণ থাকবে না–তা অর্থনৈতিক হোক, রাজনৈতিক হোক, সাংসৃক্তিক হোক বা ধর্মীয় হোক৷ এই কারণে আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এক যুগান্তকারী সামাজিক–র্থনৈতিক দর্শন–‘প্রাউট’ দিয়েছেন৷ এই প্রাউট দর্শন একদিকে যেমন পুঁজিবাদী শোষণের বীভৎস রূপকে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে, আবার কীভাবে সেই শোষণ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে তার পথও দেখিয়েছে৷ তেমনি অন্যদিকে জড়বাদী দর্শনের অসারতা ও কম্যুনিষ্ট শোষণের বীভৎস রূপটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে৷ প্রাউট দর্শনে স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, মার্ক্স্বাদী সোস্যালিজ্ম তথা কমিউনিজমও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ তাই মার্ক্স্বাদী সরকার রূপান্তরিত পুঁজিবাদ ও স্বৈরাচারী পার্টি–একনায়কতন্ত্র্ সমন্বয়৷ এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভয়ঙ্কর৷ ওদের শোষণমুক্তির শ্লোগান প্রকাণ্ড ধাপ্পা ছাড়া কিছু নয়৷ প্রাউট যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছে, জড়বাদ মানুষকে হূদয়হীন অত্যাচারী দানবে পরিণত করে৷
প্রাউট যা বলেছে তা বিংশ শতাব্দীর প্রথম অধ্যায়ে রাশিয়ার কমিউনিষ্ট সরকারের পত্তনের অব্যবহিত পর থেকে পূর্ব ইয়ূরোপ ও এশিয়ার চীন–কম্বোডিয়ার নানান্ গণহত্যার পৈশাচিকতম ঘটনাবলী থেকে শুরু করে পশ্চিমবে৷র হূদয়হীন নিষ্ঠুর দানবীয় ঘটনাবলীতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে৷ মার্ক্স্বাদের তত্ত্বগত ত্রুটির মধ্যেই এই নৃশংশতার বীজ লুক্কায়িত৷ একথা প্রাউট জোরের সে৷ই বলেছিল–যা পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷
তাছাড়া, আনন্দমার্গের প্রবক্তা কেবল যে দর্শন দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, এই দর্শনের ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের ১৮২টি দেশে আনন্দমার্গের প্রসার ঘটিয়েছেন ও খোদ পশ্চিমবে৷ও গ্রামে গ্রামে সেবাব্রতী ত্যাগী ক্যাডারভিত্তিক সুদৃৃ সংঘটন গড়েছেন৷ এই পশ্চিমবে৷ আনন্দমার্গের পাঁচ শতাধিক বিদ্যালয় সহ কয়েক হাজার ইয়ূনিট রয়েছে৷
এসব থেকেই মার্ক্স্বাদী নেতারা বুঝেছিল, আনন্দমার্গ একটা বিরাট শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করছে৷ আনন্দমার্গীরা যুক্তিবাদী, আদর্শে অবিচল, সমস্ত প্রকার শোষণ, ভাঁওতাবাজী ও চরম দানবীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধেও আপোষহীন সংগ্রামী৷
প্রধানতঃ এই কারণেই আনন্দমার্গের দ্রুত প্রচার ও প্রসারকে মার্ক্স্বাদীরা তাদের অবধারিত মৃত্যুবাণ বলে মনে করেছিল৷ তাই বার বার তারা আনন্দমার্গকে আক্রমণ করে আনন্দমার্গকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল৷
তাই পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত আনন্দনগরে আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রম যখন তৈরী হচ্ছিল, তখনই মার্কসবাদীরা এর ওপর আক্রমণ করে ৫ জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল৷ এরপরও বার বার এরা আনন্দনগরে সুক্ল, কলেজ, হাসপাতাল ও শিশুসদনের ওপর নৃশংসভাবে হামলা চালায়৷ ঠিক তেমনি কলকাতার তিলজলা এলাকাতে যখন আনন্দমার্গের নিজস্ব আশ্রম গড়ে উঠল, সে৷ সে৷ ওরা প্রথমে আশ্রমের ওপর ও পরে এই আশ্রমে এক শিক্ষামূলক সেমিনারে যোগদান করতে আসার সময় বালিগঞ্জে ও বণ্ডেল গেটে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ ওপর মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ১৭ জন সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীক্ বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে৷
ওরা ভেবেছিল এর ফলে আনন্দমার্গ শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আনন্দমার্গ শেষ হয়নি, বরং আরও দুর্দান্তবেগে আনন্দমার্গের বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে৷ আর মার্কসবাদীরাই সারা পৃথিবীতে নিঃশেষ হতে হতে শেষে পশ্চিমবে৷ও নিঃশেষ হয়ে গেল৷ যে সিপিএমের কাছে কংগ্রেস ছিল বুর্জোয়া পার্টি, এখন সেই মৃতপ্রায় কংগ্রেসের ন্যাজ ধরে মুমূর্ষু সিপিএম উঠে দাঁড়াবার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে৷ যদিও ওদের সে চেষ্টাও যে অচিরে তাদের হতাশার চরম অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷
- Log in to post comments