অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের প্রাথমিক উৎস ধরা হয় কৃষিকে৷ তারপর দ্বিতীয় স্থানে শিল্প আর শেষে অন্যান্য পরিসেবা বা সেবামূলক কাজ৷ এই প্রাথমিক উৎস থেকেই মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান আসে৷ ভেষজ উদ্ভিদ চিকিৎসা (আয়ুর্বেদিক) কাজেও সহায়তা করে৷ কৃষিতে জমির মালিক ও কর্ষক, কৃষি শ্রমিকরাই প্রধানত জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ৷ তাছাড়া জমির আগাছা পরিস্কার করতে ও ফসল তুলতে পার্ট টাইম কৃষি শ্রমিকদের ভূমিকাও কম নয়৷ উপরন্তু বাগিচা ফসল চা শিল্পে -চাপাতা তোলা মহিলা শ্রমিকদের উপরই নির্ভরশীল৷ এছাড়া কৃষিভিত্তিক শিল্পেও অনেক লোক নিযুক্ত, যথা, ধান-ভানা, মুড়ি ভাজা, খই ভাজা, চিড়া-কুটা ইত্যাদি৷
অন্য দৃষ্টিতে বস্ত্রশিল্পের সূতা তো আসে কৃষিক্ষেত্রের তুলা থেকে৷ এভাবে বলতে গেলে অনেক শিল্পের কাঁচামাল আসে প্রাথমিক সেক্টর কৃষি থেকে৷ এভাবে গ্রাম্য ভারত তথা ত্রিপুরারও প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর৷ স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ও পরে এই প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ দিন কাটাচ্ছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলায়৷ একদিন এক কর্ষক দুঃখ করে বলেছিল--- এইটুকু জমিতে আমরা গোটা পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই ভোর সাড়ে তিনটে-চারটে থেকে রাত ন’টা থেকে দশটা পর্যন্ত খেটেও দুবেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করতে পারছি না৷ সবার মজুরী হিসেব করলে দৈনিক ২ টাকা পড়ে না৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই বাস্তব সত্যটাকে হিসাবে আনতে হবে৷ ৭০ শতাংশ লোককে নিরন্ন বিবস্ত্র রেখে কোন দিন দেশের উন্নতি হবে না৷
তাহলে উপায়? উপায় একটাই প্রাউট বলে কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে৷’’ একথার মানে কি? মানে হলো শিল্পজাত দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য যেভাবে নির্ধারিত হয়--- কৃষিজ পণ্যেরও সেভাবে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করতে হবে৷ শিল্পজাত দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য নির্ধারিত হয়৷ (১) কাঁচামালের দাম (২) মূলধনের সুদ (৩) বিদ্যুৎ খরচ ও অন্যান্য শক্তি সম্পদ (৪) শ্রমিকের মজুরী দক্ষ ও অদক্ষ সবার (৫) ইন্সুরেন্স (৬) বিভিন্ন কর (৭) বিজ্ঞাপন ব্যয় (৮) পরিবহন ব্যয় (৯) লাভ---ইত্যাদি৷
অনুরূপভাবে কৃষিজ পণ্যের দাম ও নির্ধারিত হওয়া উচিত৷ যথা---(১) জমি প্রস্তুত বাবদ হাল চাষ (২) বীজের দাম (৩) কীটনাশক ঔষধ (৪) নিড়ানীসহ পূর্বাপর (৫) ফসল ঘরে তোলার ব্যয় (৬) পরিবহন ব্যয় (৭) লাভ---ইত্যাদি৷ অভাবী বিক্রি এসবের হাত থেকে কর্ষক পরিবারকে বাঁচাতে সরকার কর্ত্তৃক সহায়ক মূল্যে ফসল ক্রয় ও ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ পরিশেষে ফসল বোনা থেকে তোলা পর্যন্ত সমস্ত খরচ জোগাতে হবে অর্থাৎ স্বল্প সুদে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রাকৃতিক দুর্র্যেগে ফসল যাতে মারা না পড়ে, তার সুরক্ষায় ফসল বিমার ব্যবস্থাও থাকতে হবে৷ বেশ কয়েক বৎসর আগে সারে ভর্ত্তুকীর ব্যবস্থা ছিল৷ তাও উঠে গেছে৷ তাহলে ভাবুন একবার কর্ষক পরিবারের অবস্থা! তার উপর কৃষিকাজ তো ছয় মাসের কাজ৷ বাকি দিলগুলি?
দেশে চলছে রাজনৈতিক গণতন্ত্র মানে যেন-তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জেতা ও গদী দখল৷ এই নির্বাচনে ঘোড়া কেনা বেচা সহ সর্বস্তরেই চলে টাকার খেলা৷ তাই রাজনৈতিক দলগুলির দরকার টাকার৷ টাকার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় মোটা চাঁদা দান কারী পুঁজিপতিদেরওপর৷ ওরা নির্বাচনের পর জিনিসের দাম বাড়িয়ে সেটা উসুল করে নেয় ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনগণ ভোগে৷ জনগণের সংখ্যা গরিষ্ঠ কর্ষক সমাজতো মরেই৷
এই প্রতিবেদকের নিজের চোখে দেখা--- পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমদিকে ---বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় কর্ষক আলু করেছে জমিতে--- যা আলুর বাজার দর তাতে আলু তোলার পয়সাই উঠবে না৷ জমির আলু জমিতে পড়ে থাকে৷ কর্ষক আলু তুলে এনে বিক্রি করতে পারে না৷--- অভাবের জ্বালায় আত্মহত্যা করে৷ কর্ষকও শেষ তার পরিবারও শেষ! কাকস্য পরিবেদনা! কে করবে কৃষিকাজ? অথচ ভোক্তারা অনেক দামে আলু কিনে খায়৷
বর্তমানে কৃষিতে আর একটা সমস্যা হলো--- কৃষিতে বা কৃষিপণ্য বিপণনে পুঁজিবাদের হস্তক্ষেপ৷ এতে কর্ষক যেমন কৃষিজ পণ্যের উচিত মূল্য পাবে না তেমনি গ্রামের বেকার ছেলেরা যাঁরা সাইকেল বা ঠেলা রিক্সার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মতো বাড়ী সব্জি বিক্রি করে নিজেদের পেট চালাত তাঁরা হেরে যাবে পুঁজিপতিদের বিজ্ঞাপণে৷ পুঁজিপতিরা প্রথমে কম দামে সব্জি (জিনিষ) বিক্রি করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেড়ে নিয়ে পরে একচ্ছত্রভাবে লাভ করবে৷ এতে উৎপাদক কর্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বেকারশ্রেণী আর ক্রেতা সাধারণ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ বিষয়টা নিয়ে সবাইকেই ভাবতে হবে৷ দেশটা কিন্তু গোটা কয়েক ধনী লোকের জন্যই নয়!
কর্মসংস্থানের এই প্রাথমিক ক্ষেত্রটাকে বাঁচাতেই হবে৷ নইলে পরিণামে দেশ ও বাঁচবে না৷ রাশিয়ার মতো কৃষিপ্রধান দেশে অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিকভাবে কর্ষকের জমি কেড়ে নিতে গিয়ে ১৯১৭-১৯ এ প্রায় দুই লক্ষ কর্ষককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ প্রকৃত কর্ষক ছাড়া রাশিয়ায় বর্ত্তমানে কৃষিক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ লোকসান হয়৷ কোন কোন অতি উন্নত দেশে কৃষিকে অবহেলা করে শিল্পে মনোনিবেশ করতে গিয়ে--- এখন ভিনদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানী করতে হয়৷ অতএব, কর্মসংস্থান ও প্রাথমিক প্রয়োজন খাদ্যশস্যে সংস্থানে কর্ষকদের কথা আগে ভাবতে হবে৷ নইলে দেশও বাঁচবে না৷৷
- Log in to post comments