লক্ষণ ঃ সংস্কৃত ভাষায় ‘কুষ্ঠ’ শব্দের অর্থ চর্মরোগ৷ সে বিচারে ঘামাচিও কুষ্ঠ৷ কিন্তু সাধারণতঃ আমরা কুষ্ঠ বলতে যা’ বুঝি সংস্কৃত ভাষায় তাকে বলা হয় বাতরক্ত রোগ৷ এই রোগটি সপ্তধাতুর বিকৃতির ফলে সৃষ্টি হয় অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র এই সপ্ত ধাতু দোষযুক্ত হয়ে পড়ে কেবল সেই ক্ষেত্রেই এই বাতরক্ত ব্যাধি প্রকট হয়ে ওঠে৷
এই রোগটি সাধারণতঃ তিনটি স্তরে বিভক্ত৷ প্রথমাবস্থায় রোগী সর্ব শরীরে অস্বস্তি বোধ করে অস্থি সন্ধিতে ব্যথা বোধ করে, সময়ে অসময়ে জ্বর–জ্বর ভাব থাকে, প্রায়ই মাথার যন্ত্রণা হয়, কখনো অতিরিক্ত ঘর্ম, আবার কখনো ঘর্মের অভাব দেখা যায়, রোগী দুর্বলতাও বোধ করে৷ রোগের দ্বিতীয় স্তরে রোগী স্নায়ুতন্ত্র সমূহে সূচীবেধবৎ যন্ত্রণা অপুভব করে৷ শরীরের কোন কোন অংশে কখনো কখনো ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দেয়৷ মাথা ও ভ্রুর কেশ, লোম ঝরে পড়ে ঠোট, গাল, নাক ও চোখের কোন অংশ সঙ্কুচিত, কোন অংশ প্রসারিত হয়ে মুখ ফুলে উঠতে পারে হাত–পায়ের অংশ বিশেষও ফুলে উঠতে পারে৷ কখনও কখনও রোগী চলবার সময়ে অনুভব করে যে তার পায়ের নীচে শক্ত কিছু বিধেছে৷ রোগের এই অবস্থায় গ্রাম্য ভাষায় কুল–আঁটি রোগ বলা হয় অর্থাৎ রোগী মনে করে যেন তার পায়ের তলায় কুল–আঁটি বিঁধেছে৷ রেগের তৃতীয় অবস্থায় রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে লাল–লাল চাকা–চাকা দাগ দেখা দেয় ও ক্রমশঃ সেই স্থানগুলি অসাড় হয়ে যায়৷
কারণ ঃ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে, যথেষ্ট পরিমাণ সবুজ আনাজপাতির অভাবে ও দুগ্ধ, ঘৃত প্রভৃতি স্নেহপদার্থের দিনের পর দিন অভাব ঘটতে থাকলে রক্ত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে৷এই অবস্থায় মানুষ যদি আমাশয় বা কোষ্ঠবদ্ধতা রোগ সৃষ্টিকারী খাদ্য দীর্ঘ কাল ধরে গ্রহণ করতে থাকে অথবা অধিক পরিমাণে পচা মৎস্য, মাংস, গেঁড়ি, গুগলী বা অত্যধিক পরিমাণে বিলাতী কুমড়া (ডিংলে বা সূয্যি কুমড়া), ঝিঙে বা শাদা বেগুন ভক্ষণ করে, সেক্ষেত্রে এই রোগ নিজেকে বিস্তার করবার বিশেষ সুযোগ পেয়ে যায়৷ রক্ত থেকে ক্রমশঃ বাকী ছ’টি ধাতু দূষিত হতে থাকে কারণ রক্তের দুষ্টির ফলে দেহের প্রতিটি গ্রন্থিই দুর্বল হয়ে যায় ও সপ্ত ধাতুর বিকৃতির ফলে মানুষ তার রোগ–প্রতিরোধশক্তিও হারিয়ে ফেলে৷ দীর্ঘ দিন ধরে শ্বেতকণিকা ও রোগ জীবাণুর সংগ্রামে পরিণামস্বরূপ মেদ, মাংস, রক্ত ও রস নিঃসার হয়ে গেলে দেহের শেষাংশগুলিও শিথিল হয়ে যায় ও তাই রোগীর দেহের শেষাংশগুলি খসে খসে পড়তে থাকে৷
চিকিৎসা ঃ (আসন ও মুদ্রা)
প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপমুদ্রা, পদহস্তাসন, অগ্ণিসার, উড্ডয়ন, নৌকাসন ও শীতলীকুম্ভক করে রোগগ্রস্ত অংশ মর্দন করবে৷
সন্ধ্যায় ঃ উড্ডয়ন, অগ্ণিসার, বন্ধত্রয়যোগ, সর্বাঙ্গাসন, ময়ূরাসন৷
পথ্য ঃ রোগী কঠোরভাবে আমিষ বর্জন করবে৷ নিজের যকৃতের সামর্থ্য অনুযায়ী সব রকমের পুষ্টিকর নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করবে৷ ঘৃত, মাখন অথবা জলপাইয়ের তেল–এদের একটি না–একটি প্রাত্যহিক ভোজনের তালিকায় অবশ্যই থাকা উচিত৷ রোগী যথেষ্ট পরিমাণে (আন্দাজ ৪/৫ সের, তবে এক সঙ্গে অধিক নয়) জল পান করবে ও উপবাসবিধি মেনে চলবে৷
বিধি–নিষেধ ঃ কুষ্ঠ রোগীর পক্ষে আতপস্নান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷ রোগীর পক্ষে নদীমৃত্তিকা সর্বাঙ্গে প্রলেপ দিয়ে অবগাহন স্নান করা বাঞ্ছনীয়৷ যতদূর সম্ভব ফল–মূল, দুগ্ধ ও তরিতরকারীর ঝোল খেয়েই দিন কাটাতে হবে৷ লোভকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না৷ পাঁচ জনের ভীড়ের মধ্যে থাকা, অতি ভোজন, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ও স্ত্রীসঙ্গ কঠোরভাবে বর্জন করতে হবে৷
কুষ্ঠরোগ কোন সংক্রামক রোগ নয়৷ সুতরাং হাতে করে রোগীর রস, রক্ত স্পর্শ করলে রোগ সংক্রমিত হবে না৷ রোগীর রস, রক্ত যতক্ষণ না সুস্থ রক্তে মিশবার সুযোগ পাচ্ছে অথবা রোগীর উচ্ছিষ্টের মাধ্যমে বা শ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগবীজাণু সুস্থ মানুষের উদরে প্রবেশ করছে ততক্ষণ এই রোগ৷ বিস্তারের কোন সম্ভাবনাই থাকে না৷ কুষ্ঠ প্রধানত দরিদ্রের রোগ৷ তাই জনসাধারণ যতদিন না যথেষ্ট পরিামাণ পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে ততদিন এই রোগের প্রসার সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়৷ রোগীর পক্ষে উচ্ছের ফল বা পাতা (করলার গুণ কিছুটা কম), পলতা, নিম, শোভাঞ্জনের (শোজনে বা শাজনা) ফুল, পাতা ও ডাঁটা প্রভৃতি কোন একটি প্রাত্যহিক ভোজন তালিকায় থাকা দরকার৷ হেলেঞ্চা, গিমা, ব্রাহ্মী প্রভৃতি শাকেরও যে কোন একটি প্রত্যহ ব্যবহার করা উচিত৷
কয়েকটি ব্যবস্থা ঃ
১) প্রত্যহ কিঞ্চিৎ পরিমাণ হরীতকীচূর্ণ গুড় সহ লেহন করে খেলে এই রোগ প্রশমিত হয়৷
২) ৩টি বা ৫টি হরীতকী খণ্ড ভোজন করে অতঃপর গুলঞ্চের ক্কাথ পান করলে–
অথবা
৩) নিমছালের ক্কাথ ও পলতার ক্কাথ একত্রে মিশিয়ে পান করলে কুষ্ঠ রোগ দূরীভূত হয়৷
৪) রোগগ্রস্ত স্থানে নিমপাতার পুলটিস দিলেও ভাল ফল পাওয়া যায়৷
৫) গুলঞ্চের ক্কাথ পান করার পরে ওই ক্কাথ জীর্ণ হয়ে গেলে ঘৃত সহ অন্ন গ্রহণ করলেও কুষ্ঠ রোগে সুফল পাওয়া যায়৷
৬) গেমূত্র সহ হরিদ্রা এক মাস প্রত্যুষে প্রত্যহ পান করলে এই রোগ থেকে নিষৃকতি পাওয়া যায়৷ (‘যৌগিক চিকিৎসা ও রোগারোগ্য’ থেকে)