মানব আধারে দানব

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

ঘটনাস্থল রামপুরহাটের একটি অখ্যাত গ্রাম বগটুই৷ একটি মানুষ খুন হন, তিনি স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপপ্রধান৷ ওই খুনের পাল্টা হিসাবে সংঘবদ্ধ নির্মমতার, নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি দেখলো দেশবাসী৷ নারী শিশু সহ আটজন মানুষকে নির্মমভাবে ঘরে বন্ধ করে পুড়িয়ে মারা হল৷

পশ্চিমবঙ্গে সংঘবদ্ধ নিষ্ঠুরতার শুরু সম্ভবত সাঁইবাড়ী থেকে৷ তারপর ৫ই মার্চ-১৯৬৭ আনন্দনগর, মরিচঝাঁপি, বিজনসেতু, বানতলা, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর ৩৪ বছরে বাম জমানায় অসংখ্য নজির আজ নিষ্ঠুরতার ইতিহাস৷ বঙ্গ রাজনীতিতে খুন পাল্টা খুনের যে ধারা ষাটের দশক থেকে বহে চলেছে তা থামাবার আন্তরিক প্রয়াস কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনও দেখা যায়নে৷ সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনের পর সেই খুন সন্ত্রাস অনেকটাই বেড়ে যায়৷ যদিও রাজ্যে ক্ষমতার হাত বদলের পরে সংঘবদ্ধ নিষ্ঠুরতা না হলেও রাজনৈতিক খুনোখুনি বন্ধের কোন লক্ষণ দেখা যায়নে৷

পঞ্চায়েতের এক উপপ্রধান খুনের পর যেভাবে ঘর বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে নারী শিশুসহ আটজন মানুষকে দগ্দ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হল তাতে আশঙ্কা হয় সংঘবদ্ধ হত্যার রাজনীতি কি পশ্চিমবঙ্গে আবার ফিরে আসছে৷

রক্তপিঙ্গলের এই উন্মত্ত বর্বরতা, এই অমানবিক নিষ্ঠুরতা লজ্জায় ফেলে দিল হিটলারের গ্যাস চেম্বার, স্ট্যালিনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পকে, স্মরণ করিয়ে দিল বিজনসেতুর ১৭জন সন্ন্যাসীকে প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা৷ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের ঘটনা সংখ্যাতত্বের বিচারে ছোট হলেও অমানবিক নিষ্ঠুরতায় কোন অংশে কম নয়৷ কারণ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে নিষ্ঠুরতার বিচার হয় না৷

ঘটনা নিয়ে যথারীতি শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তর্র্জ৷ পরস্পরকে দোষারোপের পালা, সমালোচনা পাল্টা সমালোচনা৷ আক্রান্তদের প্রতি সমবেদনা নয়,এই ধরণের জঘন্য ঘটনা বন্ধ করাও নয়, আসল উদ্দেশ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে কে কতটা রাজনীতির  ময়দানে জমি দখল করতে পারে তারই লাগি কাড়াকাড়ি৷

 

ঘটনার নির্মমতা, মনুষ্যত্বের দানবীয় আচরণ এসব নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মাথা ব্যাথা নেই৷ নেতাদের কাছে ঘটনার গুরুত্ব  কোনদলের খুন হ’ল, কোন দল খুন করল এইটুকুই৷ সেই নিয়ে কিছুদিন হই হল্লা৷ তারপর এই ঘটনাও একদিন স্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাবে যেমন হারিয়ে গেছে সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি, বিজনসেতু .....অসংখ্য নির্মম নিষ্ঠুর দানবীয় ঘটনা৷ মানুষেরই দানবীয় বর্বরতা ও আরেকদল মানুষের ওই দানবীয়তা নিয়ে নির্মম রাজনীতি আর কতদিন? রাজনীতিতে স্বদেশ প্রেম ও মানব সেবার আদর্শ কী একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷

গোরুর গাড়ীর চাকা থেকে মহাকাশ যান, অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণ কুঠির থেকে আলো ঝলমল শহরের সুরম্য অট্টালিকা,সভ্যতার উল্লম্ফনে গর্বিত মানুষ নির্বিচার বিভিষিকা ও দানবীয় নৃশংসতায় নির্বিকার৷ তবু সভ্যতাকে মসিলিপ্ত করে মনে করিয়ে দেয় না কি মানুষের চতুষ্পদ পূর্ব পুরুষের কথা?

আজকের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটা মানুষ খুন হলে, মানুষ খুন করলে তার পরিচয় খোঁজা হয় কোন পার্টির, কোন সম্প্রদায়ের৷ এর বাইরে গিয়ে একবারও কি ভাবতে পারে না মানুষ কেন মানুষকে এভাবে খুন করে, মানুষ কেন এত নির্মম নিষ্ঠুর হয়৷ নিজের চারিদিকে কৃত্তিম পরিচয়ের গণ্ডিকেটে নিষ্ঠুর নির্মতার তালিম নিচ্ছে গণ্ডিবদ্ধ মানুষ নিজের জাতকে বাঁচাতে, দলকে বাঁচাতে, সম্প্রদায়কে বাঁচাতে৷ আর এসব করতে গিয়ে মনুষ্য মর্যাদা গর্ব যে ভূলুন্ঠিত তা একবারও এদের মনে জাগে না৷

সত্যিই মানুষ আজও মানুষ হয়ে উঠতে পারলো না, দ্বিপদ জীব হয়েই থেকে গেলো৷ তার অমানবিক আচরণ পশুর পাশবিকতাকেও লজ্জা দেয়৷ শুভবুদ্ধি হারিয়ে, কল্যাণের আদর্শকে উপেক্ষা করে নির্মম নিষ্ঠুর কাণ্ড ঘটিয়ে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় উন্মাদ বর্বরের দল রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে৷

এই বর্বর নির্দয়তার পর শুরু হয় আর এক ধরনের নির্লজ্জ রাজনীতি৷ অনেক সময়েই লজ্জার মাথা খেয়ে অপরাধীকেই সমর্থন করে৷ যেমনটা দেখা গিয়েছে বিজনসেতু হত্যা কাণ্ডের পর৷ শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরাই আস্ফালন করে বলেছেন ‘আনন্দমার্গীরা ধোয়া তুলসীপাতা নয়’৷ যদি যুক্তির খাতিরে ধরেই নেওয়া হয় আনন্দমার্গীরা ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তা বলে এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মারা কোন মনুষ্যত্বের পরিচয়! সেই পাপ বাড়তে বাড়তে আজ রামপুরহাটের এক গণ্ডগ্রামে পৌঁছে গেছে৷

এখনও যদি সম্বিত না ফেরে, এখনও মানুষের মনুষত্ব্য ভুলে পরিচয় খোঁজে ওই সম্প্রদায় সেই সম্প্রদায়কে মেরেছে, সেই পার্টি এই পার্টিকে মেরেছে, ভুলেও একবার কী মনে আসে না মানুষ মানুষকে মারছে! এই উন্মত্ত বর্বরতা, এই দানবীয় নিষ্ঠুরতা মানুষের মধ্যেই মাথা তুলছে ভয়ঙ্করভাবে৷ খুনের বদলে খুন! বর্বরতা দিয়ে বর্বরতার জবাব কি মানুষের শোভা পায়! এই ভয়ংকর ঔদ্ধতার, নৈরাজ্যের মধ্যে কিছু মানুষ কি মাথা উঁচু করে বলতে পারে না ওরা মানুষ নয়, মানব আধারে দানব৷ এই দানবিকতার বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবুদ্ধি৷ মানুষ উঠে দাঁড়াক, মনুষ্যত্বের পরিচয়ে৷