মানব ধর্ম

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

বৃক্ষলতার কিছু বিশেষ গুণ আছে৷ যেমন, মাটির নীচে থেকে রস টেনে নেওয়া৷ মানুষ নিতে পারে না৷ জন্তু–জানোয়াররাও নিতে পারে না৷ কিন্তু বৃক্ষলতারা মাটির থেকে রস টেনে নিতে পারে৷ বাতাস থেকেও এরা কিছু খাদ্য নেয়৷ যদিও জীবজন্তু, মানুষও কিছুটা তা করে, কিন্তু উদ্ভিদের মত অতটা নয়৷ একে আমরা বলতে পারি উদ্ভিদ–ধর্ম৷ বৃক্ষলতা পায়ের সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ করে৷ তোমরা জান কি না? ‘পাদপ’ মানে যে পায়ের সাহায্যে পান করে৷ পাদ - পা + ড = পাদপ৷ উদ্ভিদ্ মানে মাটি ভেদ করে যে ওপরে ওঠে৷ এই উদ্ভিদের যেমন কিছু বিশেষত্ব আছে, তেমনি জীবজন্তুর মধ্যেও বিশেষত্ব আছে৷ উদ্ভিদের যা বিশেষত্ব তা–ই হ’ল তার জীবনধর্ম৷ পশুদেরও অতিরিক্ত কিছু বিশেষত্ব আছে৷ তা হ’ল পশুধর্ম৷ পশু পশুধর্ম পালন করবে৷ এতে তাদের কোনো দোষ নেই৷ বাঘ মানুষের ওপর আক্রমণ করবে, মানুষকে খাবে৷ এতে তার দোষ নেই, এটা তার পশুধর্ম৷ তার পক্ষে এটা খারাপ কাজ নয়৷ কিন্তু মানুষ যদি মাংস খায়, তা পশুধর্মের মধ্যে পড়ে যায়৷ তোমরা বুঝছ? হ্যাঁ, মানুষকে মানবধর্মের মধ্যে থাকা উচিত৷ মানবধর্মের বিশেষত্ব হ’ল, সে বিচারশীল৷ বিচারশীলতার জন্যে তার জীবনে চারটা স্তর এসে যাচ্ছে৷ এই চারটে স্তরের পথ ধরে যখন মানুষ চলবে, সেটাই হ’ল মানবতার পথ–এই হ’ল মানবধর্ম৷ উদ্ভিদ্ধর্ম, পশুধর্ম আর মানবধর্ম৷ মানবধর্মের আর এক নাম ‘ভাগবত ধর্ম’৷ এতে হিন্দু, মুসলমান প্রভৃতি ভেদ নেই৷ ওই সব তো মজহব (Religion)৷ মানবধর্ম হচ্ছে সমস্ত মানুষের ধর্ম৷ সমস্ত মানুষের একটাই ধর্ম৷ তাই আমরা বলি, ‘‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই’’, ‘‘সকল মানুষের ধর্ম এক’’৷

এই যে মানবধর্ম বা ভাগবত ধর্ম –এই ধর্ম আজকের নয়৷ যখন মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল, তখন থেকেই এই ধর্ম রয়েছে৷ এর আদি কোথায়? যেখানে মানুষের সূত্রপাত, মানবধর্মের আদি সেখানে৷ তাই একে আমরা বলি  সনাতন ধর্ম–যা শুরু থেকেই রয়েছে৷ আর এর চারটে স্তর হচ্ছে– বিস্তার, রস, সেবা ও তদ্স্থিতি৷

ভাগবত ধর্মের মূল কথা কী? ‘বিস্তার’ (Expansion of microcosm) –মানসিক বিস্তার৷ ‘রস’ মানে হ’ল, এটাই অনুভব করতে হবে যে, In the universal stream of life, in the universal stream of expression,  I am not a separated entity। পরমপুরুষের যে অতি–বৈয়ষ্টিক প্রবাহ, আমি তা থেকে পৃথক থাকতে পারি না৷ তাঁর তরঙ্গে আমাকে ভেসে যেতে হবে৷ সে তরঙ্গে আমাদের নাচতে নাচতে এগিয়ে চলতে হবে৷ পরমপুরুষের রসপ্রবাহে মানুষের এই যে ভেসে চলা, তাকেই বলে পরমপুরুষের ‘রাসলীলা’–তাঁর রস প্রবাহে নেচে চলা৷ এই অখণ্ড রসপ্রবাহ অনাদি থেকে অনন্তের দিকে বয়ে চলেছে৷ এই যে পরমপুরুষের লীলাপ্রবাহ, এর থেকে আমরা পৃথক হয়ে থাকতে পারি না৷ একেই বলা হয় ‘রস’৷ প্রথম হ’ল বিস্তার, দ্বিতীয় হ’ল ‘রস’৷ আর তৃতীয় ‘সেবা’৷ পশুজীবনে সেবা নেই, পশুজীবনে যদি কিছু থাকে–তা কী? Mutual transaction––পারস্পরিক বিনিময়৷ আমরা হিন্দীতে বলি ‘ব্যাপার’৷ ইংরেজীতে Carnivorous, দু’টাকা দিলুম, আর দু’টাকার লবণ নিলুম৷ বিনিময় হ’ল, সেবা নয়৷ শাস্ত্রে এর নাম ‘ব্যবসায়’৷ এই ‘সেবা’ হ’ল মানুষের বিশেষত্ব৷ এটা পশুজগতে নেই৷ যেমন, কুমীর৷

জলে থাকে কুমীর, ইংরেজীতে crocodile, মগরমচ্ছ, মগর, সংসৃক্তে মকর৷ কুমীর কী করে? কুমীর তো মাংসাহারী Carnivorous. তারা খাওয়ার পর কী করে? তখন জলে থাকে না৷ ওরা জলে যায় কেবল শিকার ধরার জন্যে৷ কুমীর আসলে জলের প্রাণী নয়, ডাঙ্গার প্রাণী৷ ডাঙ্গায় উঠে কুমীর কী করে? মুখ হাঁ করে থাকে৷ তার দাঁতের ভেতর মাংস ঢুকে থাকে৷ ছোট ছোট পাখী আসে, তার মুখের ভেতর ঢুকে যায়, আর দাঁতের গোড়ায় যে মাংস লেগে থাকে, তা খেতে থাকে৷ পাখীর খাদ্য জুটে গেল৷ আর কুমীরের দাঁত পরিষ্কার হয়ে গেল৷ পরস্পর বিনিময় হ’ল৷ ওই সময় কুমীর মুখ বন্ধ করবে না৷ তাহলে পাখী মরে যাবে৷ তাই তা করবে না৷ এ হ’ল ব্যবসায়৷ পাখী বলবে, আমি তোমার দাঁত থেকে মাংস পাচ্ছি৷ আর কুমীর বলবে, তোমার দয়াতে আমার দাঁত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে৷ এই হ’ল বিনিময়৷ টাকা নাও, লবণ দাও৷ এ হ’ল ব্যবসায়৷

মানুষের মধ্যে একটা অতিরিক্ত জিনিস আছে, তার নাম সেবা৷ সেবা কী? দেব–কিছু নেব না৷ একতরফা ব্যাপার  (Unilateral transaction—One sided transaction)৷ মানুষ যখন দান করে, মনে কর, কোনো ভিখারীকে তুমি দান করছ, তখন তুমি বিনিময়ে কি কিছু নিচ্ছ? বা নেওয়ার ভাবনা রাখ? কাকে তুমি দিলে তাও কিছুদিন পরে ভুলে যাও বা ওই দিনই ভুলে যাও৷ এই হ’ল সেবা৷ পশুর মধ্যে এই সেবাভাব নেই৷ মানুষের এটা বিশেষত্ব৷ মনে কর, আজ কেউ এক লাখ টাকা দান করল৷ তারপর রাতে ঘুম হচ্ছে না৷ মনে মনে ভাবছে, কাল সকালে আমি দেখব, যে অমুক শেঠ, চোট্টামল ডাকুমল বাটপাড়িয়া.....এত টাকা দান করেছে৷ এটা কী হ’ল? সেবা নয়, বিনিময়৷ দান কর, তারপর সে কথা ভুলে যাও৷ দান হবে একতরফা, Unilateral। পরমপুরুষকে কী দেবে? পরম পুরুষকে ফুল দিচ্ছ....‘এতানি পুষ্পানি...’ আর মনে মনে বলছ, হে পরমপুরুষ, ছেলেটা যেন পরীক্ষায় পাশ করে যায়, মেয়েটার যেন বিয়ে হয়ে যায়, পরমপুরুষ, আমার কাকাতুত ভাইয়ের সঙ্গে যে মামলাটা চলছে, ওই মামলায় যেন আমার জয় হয়৷ এসব কী ঠিক হচ্ছে? –না, ঠিক নয়৷ নিজেকে দাও, নিজেকে যখন দিয়ে দিলে, তখন সবথেকে বেশী লাভও হয়ে গেল৷ তখন তুমি পরমপুরুষ হয়ে গেলে৷ পরমপুরুষের সঙ্গে এক হয়ে গেলে তো তুমি সবকিছুই পেয়ে গেলে৷ কিন্তু যদি তুমি চাও, এক আনা পকেটে রেখে পরমপুরুষকে পনের আনা দিই, তাহলে ওই এক আনার জন্যে তুমি পরমপুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যেতে পারবে না৷ এর জন্যে দিতে হয় তো ষোলো আনা দাও৷ একেই বলে সেবা৷ এই হ’ল বিস্তার, রস ও সেবা৷ আর চতুর্থটি কী? ‘তদ্স্থিতি’৷ অবশেষে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া, এ সমস্ত গুণ পশুতে নেই৷ এটা পশুধর্ম নয়, এটা মানবধর্ম৷ তাই গীতাতে বলা হয়েছে কী?

‘‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্ম স্বনুষ্ঠিতাৎ৷’’

এর অর্থ হ’ল, তুমি মানুষ, মানবধর্ম মেনে চল, এতেই দৃঢ় থাকো৷ মানবধর্মের জন্যে যদি তোমার মৃত্যুও হয়, তাও ভাল, পরধর্ম তোমার জন্যে ভয়াবহ–ভয়ঙ্কর৷ পরধর্ম মানে পশুর ধর্ম, গাছপালার ধর্ম–তোমার কাছে পরধর্ম৷ এখানে হিন্দুধর্ম, মুসলমান ধর্ম–এসবের কথা বলা হচ্ছে না৷ মানবধর্মের কথা বলা হচ্ছে৷ বলা হয়েছে, কৃষ্ণ বলছেন, মানবধর্ম পালন করা যদি কষ্টদায়কও হয়, আর পশুধর্ম পালন করা যদি সুখদায়কও হয়, তাহলেও মানবধর্ম নিয়ে বেঁচে থাক, পশুধর্ম নিয়ে নয়৷ মানবধর্মে অবিচলিত থেকে যদি মৃত্যুও হয়, তা–ও ভাল, কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতে পশুধর্ম মেনে চলো না৷  

(সন্ধ্যাকালীন জেনারাল দর্শন, ১৫ অক্টোবর, ১৯৭৯, নাগপুর)