বঙ্গ রাজনীতিতে মুখোশের আড়ালের মুখগুলো ক্রমশ বেরিয়ে আসছে৷ হতাশা গ্রাস করেছে এক শ্রেণীর নেতাদের৷ কারণে অকারণে মেজাজ হারাচ্ছে৷ হাব-ভাব - বাচন - ভঙ্গীমায় - ভাষায় শালীনতা বজায় থাকছে না৷ আসলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মমতকে হাতিয়ার করে উত্তর পশ্চিম ভারতে যে সাফল্য পেয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল তার বঙ্গীয় অনুগামীরা সেই পথেই বঙ্গ জয়ের স্বপ্ণ দেখছে৷ কিন্তু বাঙলার সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সর্র্বেপরি এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিচক্ষনতার কাছে বার বার পরাজিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে৷ তবে শুধু ধর্মীয় কারন নয়, বর্তমান রাজনীতি ব্যষ্টিস্বার্থ ও স্বজন পোষণ রোগে আক্রান্ত৷ তাই ব্যষ্টিস্বার্থ সিদ্ধিই যখন রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে যায়, অথচ লক্ষ্য পুরণের উপায় থাকে না তখন নেতাদের মধ্যে অস্থিরতা অশালীন আচরণ প্রকট হয়ে ওঠে৷ সম্প্রতি রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি ও প্রাক্তন সাংসদ খড়গপুরে একটি রাস্তার উদ্বোধন করতে গিয়ে মহিলাদের অশ্লীল ভাষায় গালি দিলেন৷ গত লোকসভা নির্বাচনে জনগণের দ্বার প্রত্যাখিত ও দলে উপেক্ষিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিলেন, না-কি মনুবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে এই আচরণ! কারণ বিজেপি নামক দলটাই মনুবাদী৷ মনুবাদে নারীর স্থান পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক নীচে৷
বঙ্গ রাজনীতিতে এই ধারা পশ্চিম থেকে আমদানি হয়েছে৷ স্বাধীনতা পূর্ব গান্ধী সুভাষ সংঘাতের সময় গান্ধী অনুগামীদের মধ্যে অসংযমী আচরণ দেখা গিয়েছিল৷ সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অনেক কটু কথা বলেছিল৷ তবু আজকের মতো এমন অশালিন ভাষা প্রয়োগ করতো না৷ কিন্তু সুভাষচন্দ্র বা তাঁর অনুগামীদের আচরণ সব সময় সংযত থাকতো৷ বাঙলার রাজনীতিতে একটা মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্র৷
স্বাধীনতা পরবর্ত্তীকালে বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন পর্যন্ত সেই মূল্যবোধ অনেকটাই বজায় ছিল৷ এই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মূলে আছে বাঙলার কম্যুনিষ্ট রাজনীতি প্রফুল্ল সেনের আমল থেকে৷ তবে তখনও ব্যষ্টি আক্রমণে কম্যুনিষ্টরা মিথ্যার আশ্রয় নিলেও আজকের মতো ভাষায় এতটা অশালীন ছিল না৷ প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে ছিল কম্যুনিষ্টরা৷ তবে তখনও মনুবাদী ভাবধারা গ্রাস করেনি বাঙলার রাজনীতিতে৷ হয়তো মনুবাদী ভাবধারা নেতাদের মধ্যে সুপ্ত ছিল৷ বঙ্গ রাজনীতির পুরোভাগে কোন মহিলা নেত্রী না থাকায় মনুবাদী ভাবধারা প্রকাশ পায়নি৷
ধর্ম বিরোধী সমাজশাস্ত্র বিদ্বেষী কম্যুনিষ্টরাও যে মনুবাদে আচ্ছন্ন সেটা প্রকাশ পায় বঙ্গ রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের পর থেকে৷ মমতা বন্দোপাধ্যায়ে প্রতাপ যত বাড়তে থাকে কম্যুনিষ্ট আদর্শের মুখোশ খুলে কম্যুনিষ্টদের মনুবাদী চেহারা তত নগ্ণ হতে থাকে৷ ২০১১-তে বিধানসভা নির্বাচনের সময় সেই চেহারা আরও কদর্যরূপ ধারণ করে৷ একজন মহিলা নেত্রী সম্পর্কে কদর্য ভাষা ব্যবহার করেন বামফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্বের সর্র্বেচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যষ্টিও৷
বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সবাই ছিলেন এলিট সম্প্রদায়ের৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়েন না৷ একেবারে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা সাধারণ একটি মেয়ে৷ তাঁর এই দাপট তথাকথিত এলিটদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ তাই ডান-বাম-রাম সব পক্ষই মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে মনুবাদকেই আশ্রয় করেছে৷ যদিও মনুবাদে অশালীন ভাষা ব্যবহারের বিধান নেই৷
রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে সওয়াল করতে নয়, এত সাত কাহন লেখার উদেশ্য এই নিকৃষ্ট রাজনীতি বাঙলার উন্নত সাংস্কৃতিক মনস্ক আচরণে কালী লেপন করছে তাই৷ স্বাধীনতা পূর্ব বাঙলার রাজনীতিতে যে মূল্যবোধ ছিল তা অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে৷ মনুবাদী ছুঁতমার্গ থেকে বাঙালী অনেক দূরে--- এইগর্বটুকুও আর করার জায়গা থাকছে না৷ বঙ্গ রাজনীতিতে পশ্চিমভারতীয় মনুবাদী সংস্কৃতি নিয়ে বিজেপির উদয় ও ক্ষমতাচ্যুত সিপিএমের বেসরম আচরণ বাঙালীর রাজনৈতিক মূল্যবোধকে মহাশূন্যে স্থাপন করেছে৷
- Log in to post comments