‘না তাকাইঁ’

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

রাঢ়ের মানুষ একদিকে  যেমন দার্শনিক চিন্তা করেছে, অন্যদিকে তেমনি হালকা মেজাজে হাসি–তামাসা–নৃত্য–গী উচ্ছল হয়ে উঠেছে৷ রাঢ়ের মানুষ মজলিশী, মিশুক ও খোসমেজাজী৷ দারিদ্র্যভারে জীর্ণ হলেও সে মানুষকে ডেকে খাওয়ায়–খাওয়ায় তা–ই যা সে নিজে খায়–ভাত, কলাইয়ের ডাল (রাঢ়ী বাংলায় ‘বিরি’), বড়ি–পোস্ত আর কুমড়োর তরকারি (রাঢ়ী বাংলায় ‘ডিঙ্লা’)৷ তার আচরণে–ব্যবহারে কোনো দারিদ্র্যগত সংকোচ নেই৷ বিনা কষ্টেই সে স্পষ্ট কথা বলে থাকে৷ রাঢ়ের মানুষের সরলতার একটি নিদর্শন ঃ

জনৈক সরলৰুদ্ধি অশিক্ষিত রাঢ়ী কর্ষককে১ বিচারক নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন–‘‘হাঁ রে, তু যে বলছিস জমিনটা তুর তা তু বলত্যে পারিস জমিনটাতে ক’টা আল আছে?’’ অশিক্ষিত কর্ষক সে প্রশ্ণের উত্তর দিতে পারলে না৷ সে আকাশ পানে চেয়ে রইল৷ বিচারক শুধোলেন–‘‘কী ভালছিস (দেখছিস) বটেক?’’ কর্ষক তখন শুধোলে–‘‘হাঁ রে সাহেব, তু যে ই ঘরটাতে অনেকদিন ধর্যে ম্যাজিসটারি করছিস তা তু উপরদিকে না তাকাইঁ বল না কেনে ঘরে ক’টা কড়ি–বরগা আছে৷’’ তখন বিচারক শুধোলেন–‘‘তু যে ই কথাগুলান বললি ইটা তুকে কে শিখাইঁ দিইছিল?’’ কর্ষক বললে–‘‘কেউ শিখাইঁ নাই, মু লিজেই বললম, বাকী কথাগুলান উকিলবাবু শিখাইঁ দিইছিল৷ মু ল্যাজ্য কথা বললম, তু ল্যাজ্য বিচার কর্৷’’

রাঢ়ের মানুষ এমনই সহজ সরল৷ তাই রাঢ়ের গ্রাম্যজীবনে যেমন উৎসবের অন্ত নেই, তেমনি আমোদ–প্রমোদের উপকরণেরও অন্ত নেই৷ সস্তা ও সাধারণ বিলাস–ব্যসন রাঢ়ের মজ্জাগত৷ তবে তাকে কিছুতেই রাঢ়ের সহজ সরল জীবনের পরিপন্থী হতে দেওয়া হয়নি৷

১৷ ‘কৃষক’ শব্দটি বৈয়াকরণিক বিচারে অশুদ্ধ৷

২৷ ঘটনাটি সম্ভবতঃ জামতাড়া আদালতে ঘটেছিল৷

 

সেন্সর

ব্যাকরণে সমাস নির্দ্ধারণ করতে গেলে আগে ব্যাসবাক্য ঠিক করতে হবে অর্থাৎ অর্থ উহ্য না রেখে আসল রূপটি ফুটিয়ে তুলতে  হবে৷ নতুবা সমাস  নির্দ্ধারণ করা  সম্ভব হবে  না৷ প্রসঙ্গতঃ একটা গল্প মনে পড়ছে

একবার লণ্ডনের এক পশুশালায় (আমরা যাকে চিড়িয়াখানা বলি) এক সিংহী চারটি শাবক প্রসব করেছিল৷ সংবাদটি প্রকাশনার্থে প্রেসে দেবার পূর্বে সেন্সর–ফিসার সেটি যখন তাঁর ওপরওয়ালার কাছে পাশ করবার জন্যে পেশ করলেন, তাতে লেখা ছিল, ‘লণ্ডনের এক পশুশালায় এক সিংহী চারটি শাবক প্রসব করেছে৷’

সংবাদটি দেখে ওপরওয়ালা অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন–‘‘লণ্ডন শব্দটি কেন রেখেছে, এতে শত্রুর সুবিধা হতে পারে’’ সুতরাং বাক্যটিকে করে দেওয়া হল–‘ইংল্যাণ্ডের কোনো একটি শহরে কোনো একটি পশুশালায় একটি সিংহী চারটি শাবক প্রসব করেছে৷’

তিনি যখন এই পরিবর্ত্তিত সমাচারটি তাঁর  ওপরওয়ালার কাছে পাঠালেন তিনি বললেন–ইংল্যাণ্ডের পশুশালা বলতে লণ্ডনের পশুশালাই ৰোঝাচ্ছে৷ এতে তো শত্রুর সুবিধা হয়ে যাচ্ছে৷ তাই লেখা হল, ‘পৃথিবীর কোনো একটি দেশের কোনো একটি পশুশালায় একটি সিংহী চারটি শাবক প্রসব করেছে৷’

তিনি যখন সমাচারটি তাঁর ওপরওয়ালার কাছে পাঠালেন তিনি বললেন–লণ্ডনের পশুশালা পৃথিবীর সেরা পশুশালা৷ এর জুড়ি মেলা ভার৷ তাই পশুশালা বললেই লণ্ডনের পশুশালা বোঝাবে৷ তাই তিনি সমাচারটিকে করে দিলেন–‘পৃথিবীর কোনো একটি দেশের কোনো একটি শহরের কোনো একটি স্থানে কোনো একটি সিংহী চারটি শাবক প্রসব করেছে৷’

সংবাদটি তাঁরও ঊর্ধ্বতম অফিসারের কাছে পাঠানো হলে তিনি বললেন–আরে, তোমাদের এতটুকু ৰুদ্ধি নেই৷ সিংহ মানেই তো ব্রিটিশ সিংহ৷ তাই সিংহ বললেই তো সব ধরা পড়ে যাবে৷ তাই তিনি করলেন, ‘পৃথিবীর কোনো একটি দেশের কোনো একটি শহরের কোনো একটি স্থানে কোনো একটি পশু চারটি শাবক প্রসব করেছে৷’

খবরটি যখন সর্বোচ্চ অফিসারের কাছে পৌঁছুল তিনি বললেন–‘তোমাদের আর ৰুঝিয়ে পড়িয়ে শিখিয়ে পারলুম না৷ প্রকৃত সংখ্যা কি কখনও বলতে আছে কোনো অবস্থাতেই বলতে নেই৷ নিজেদের সুবিধামত কখনও ৰাড়াতে হয়, কখনও কমাতে হয়, কখনও উহ্য রাখতে হয়৷ তাই খবরটা শেষ পর্য হয়ে গিয়ে দাঁড়াল, ‘পৃথিবীর কোনো একটি দেশের কোনো একটি শহরের কোনো একটি স্থানে কোনো একটি পশু কয়েকটি শাবক প্রসব করেছে৷’

তাই বলছিলুম, সমাসের ব্যাসবাক্য রচনায় যেন এই ধরনের সেন্সর নীতি অনুসৃত না হয়৷ এতে সমাস নির্দ্ধারণে কোনো সুরাহা হবে না৷