পশ্চিমবঙ্গের নোতুন নামকরণের প্রশ্ণটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ এ সম্পর্কে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চিন্তাভাবনাও করছেন৷ সরকারী বিচারে ‘বাংলা’ নামটাই নাকি পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত৷
কোন ভূমিখণ্ডের নামকরণের বিষয়টি মুখ্যতঃ পাঁচটি তত্ত্বের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত৷ নামকরণের এই পাঁচটি তত্ত্ব হলো--- সংশ্লিষ্ট ভূমিখণ্ডে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বা জাতির ১) ইতিহাস,২) ভাষা ও সংস্কৃতি,৩) বসবাসের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি, ৪) অর্থনীতি ও ৫) নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যপ্রসূত ভাবপ্রবণতা৷
নামকরণের এই পাঁচটি মুখ্যতত্ত্বের সঙ্গে আরও দু-চারটি গৌণতত্ত্ব বিচার্য্য হওয়া বাঞ্ছনীয়৷ (১) এই নামকরণে যেন সাম্প্রদায়িক বা জাতপাতের গন্ধ না থাকে,(২) সংশ্লিষ্ট জাতির আবাসভূমির বর্ত্তমান বাস্তব পরিস্থিতি, (৩) সংশ্লিষ্ট জাতির সামাজিক প্রগতিশীল গতিতত্ত্বের সঙ্গে নামকরণের ভাবগত সংহতি রক্ষা ও (৪) নির্বাচিত নোতুন নামের ভাব-ব্যঞ্জনা, ধবনি-ব্যঞ্জনা সুর লালিত্য ও মূল্যবোধ যেন সংশ্লিষ্ট জাতির ভাব, শক্তি, বিস্তার ও রুচির সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়৷
অতীতে আমাদের বঙ্গভাষাভাষীদের বিরাট দেশ পঞ্চগৌড়কে অন্যান্য দেশের নানা ভাষাভাষী লোকেরা নানা নামে ডাকতেন৷ এপ্রসঙ্গে দার্শনিক ও ঐতিহাসিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মহাশয় বলেছেন,
‘‘বাঙলার বাইরে দেশটি অতি প্রাচীনকালে গৌড়দেশ বা পঞ্চগৌড় নামে পরিচিত ছিল৷ বৌদ্ধযুগ থেকেই ‘বঙ্গাল’ শব্দটি চলে এসেছিল যার ভাবারূঢ়ার্থ হল বঙ্গের কাছাকাছি জায়গা৷ বেতাল পঞ্চবিংশতিতে বেতাল মহারাজ বিক্রমাদিত্যকে বলছেন ‘‘মহারাজ, গৌড়দেশের বর্দ্ধমান নগরে৷’’ চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ে রয়েছে---‘‘ভু-সু-কু আজ তু বঙ্গালী ভইলি৷’’ কেউ কেউ ভাবেন পাঠান যুগ থেকে দেশটির নাম ‘বঙ্গাল’ হয়েছে৷ তা ঠিক নয়৷ চীনা ভাষায় গত পাঁচ হাজার বছর থেকে আমাদের এই গৌড় দেশকে বলা হয়েছে ‘বাঞ্জালা’৷ লাতিনে এই দেশকে বলা হয় ‘বাঞ্জাল’ (বাঙলায় জাত এই অর্থে লাতিন ভাষায় বলা হয় বাঞ্জালাইটিস্) তুকীতে বলা হয় ‘বাঙ্গালা’, আরবীতে ‘বাঙালা’৷ ফার্সী,উর্দু ও হিন্দীতে ‘বঙ্গাল’ , ইংরেজীতে বেঙ্গল সংস্কৃতে গৌড়দেশ’, বাংলায় বলা হয় ‘বাঙলা দেশ’৷ এই ‘বাঙলা দেশ’ ও গৌড়দেশের অংশ বিশেষকে নিয়ে শ্রদ্ধেয় মুজিবর রহমান মরহুম পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেছিলেন ‘বাংলাদেশ’৷
(বাংলা ও বাঙালী---পৃঃ ১৪৮---১৪৯)৷
আমাদের বসবাসকারী ভূমিখণ্ডের নানা নামের প্রাচীন ঐতিহ্য আজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু৷ সময়ের প্রবাহে রাজনৈতিক ভাঙাগড়া ও উপধর্মীয় সংঘর্ষের পরিণামে আমাদের সেই বিশালদেশ পঞ্চগৌড় আজ নানা দেশ বা প্রদেশে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে৷ খণ্ড বিখণ্ড সেই ভূগোলের একটি ক্ষুদ্র অংশ এই পশ্চিমবঙ্গ যার নোতুন নাম নির্র্দ্ধরণের প্রশ্ণটি আজ আলোচনার বিষয়৷
হঠাৎ করে খেয়ালের বশে বা রাজনৈতিক চমক দেবার বালখিল্য ইচ্ছায় যদি পশ্চিমবঙ্গের কোন মন্ত্রী বা বিধানসভার সদস্য তাঁদের ব্রুট মেজরিটির জোরে এই প্রদেশের নাম পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তে শুধু ‘বাংলা’ করে দিতে উদ্যোগী হন তন্েব সেটা হবে ঘোর অন্যায়৷ প্রাচীন ঐতিহ্যশীল কোন দেশের নাম পাল্টে দেবার প্রশ্ণটি তাই অত জলবৎ তরলং ব্যাপার নয়৷ ইতোপূর্বেও পশ্চিমবঙ্গের নাম পাল্টাবার প্রয়াস হয়েছিল৷ তখন এ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল৷ এমনকি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জ্ঞানী-গুণী সদস্যরাও প্রতিবাদ জানাতে সেদিন সরব হয়ে উঠেছিলেন৷
ভাষাচার্য্য শ্রদ্ধেয় শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর ‘‘বাঙালীর সংস্কৃতি’ পুস্তকটিতে বলেছেন,
‘‘পাকিস্তান স্থাপনের পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও পূর্ববঙ্গ’ এই দুইটি খণ্ডদেশরূপে অবিভক্ত বঙ্গদেশ আবার দেখা দিল৷ যতদিন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বা পশ্চিমবাঙলা ও ‘পূর্ববঙ্গ’ যা পূর্ববাঙ্গালা এই দুটি নাম থাকিবে, ততদিন একটি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী বঙ্গভাষী জাতির পূর্বস্মৃতি ও ভবিষ্যৎ আশাও হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীর মন হইতে একেবারে মুছিয়া যাইতে পারিবে না৷ ‘পশ্চিমবঙ্গ (ওয়েষ্টবেঙ্গল) বলিলেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার জবাব রূপে পূর্ববঙ্গ (যা ইষ্ট বেঙ্গল) নামও আপনা হইতেই আসিবে৷’’
শ্রদ্ধেয় ভাষাচার্য্য মহাশয় বাঙালী জাতির ‘পূর্ব-স্মৃতি’ ও ভবিষ্যৎ আশাকে জিইয়ে রাখার ইচ্ছায় পশ্চিমবঙ্গ নামটিকেই রেখে দেবার পক্ষে প্রকারান্তরে মত দিয়েছেন! তাঁর এই সদিচ্ছায় প্রতি সম্মান জানিয়েও বলছি ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এই নামটির মধ্য দিয়ে বাঙালী আজ প্রতিনিয়ত একটি খণ্ড জাতি বা দ্বিজাতিতে বিভক্ত হয়ে থাকার দুঃখজনক নেতিবাচক বিচ্ছেদ ভাবটি প্রতিনিয়ত মনের গভীরে বহন করে চলেছে৷ আর এই চাপা পুঞ্জীভূত ব্যথা তার মনের মধ্যে হাতুড়ী পিটিয়ে চলেছে৷ অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে হারাবার বেদনা আর ভবিষ্যতে সেই ঐতিহ্যময় বিশাল ভূখণ্ড আবার ফিরে পারার যন্ত্রণাময় প্রতীক্ষা করে চলা--- এই দুই বিপরীত ভাবের মানসিক দ্বন্দ্বের উৎস হলো এই ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি৷ এতে একটি জাতির মনে বে নেতিবাচক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাতে তার সামুহিক মানস তরঙ্গে জমে ওঠে হতাশা, ক্ষোভ ও বিদ্বেষ৷ তাই এখন এমন একটি নাম নির্র্বচিত হওয়া উচিত যার মধ্যে অতীতের গৌরব ও ভবিষ্যতের আশা---উভয় ভাবদ্বয় ইতিবাচক ভাব-সেতু রচনা করবে৷ এই ভাব-সেতুর প্রভাবে বর্ত্তমানে বাংলাভাষী প্রধান বহুধা বিভক্ত অঞ্চলগুলি পুনরায় একত্রিত হয়ে পুরনো পঞ্চ গৌড়ের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বাস্তব পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে৷ সেই নোতুন নামটি কি হলে ভাল হয়? সেই প্রশ্ণের উত্তর খুঁজতেই এই প্রবন্ধের আলোচনা এগিয়ে চলেছে৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments