ভূতকে ভয় পেয়ে সন্ধের পরে কেউ কেউ বলেন–উনি......তিনি.......তাঁরা হাওয়ায় ভর দিয়ে চলেন–সেই যে নাম নিতে নেই......দেখে এখনই গা ছমছম করছে......ওই শ্যাওড়া গাছটির দিকে একদম তাকিও না৷
যাঁরা এমন বলেন তাঁরা ভূত–প্রেতকে উপদেবতা বলেন৷ দেখনি, সাপের ভয়েতে রাত্রিতে লোকে সাপকে ‘লতা’ বলে৷ দিনের আলোয় সাপকে সহজেই দেখা যায়৷ তাই কিছুটা সতর্ক থাকাও যায়৷ রাতে ভাল করে দেখা যায় না তো, তাই রাতে ভূতের ভয়ের মত সাপের ভয়ও ৰেশী৷ তাই দিনের বেলায় যাঁরা ভূতকে ভূত বলেন, রাত্রে তাঁরা বলেন, উনি......তিনি......ইত্যাদি৷ আবার রাত্রে তাঁরা সাপকে বলেন ‘লতা’৷ বসন্ত হলে বলেন, ‘মায়ের দয়া হয়েছে’৷
সেটা ১৯৪০ সাল৷ কলকাতায় সেবার দারুণ বেরিবেরি রোগের প্রাদুর্ভাব৷ কলকাতার আশেপাশের শহরগুলিতেও সেই অবস্থা৷ ওলাওঠার১ (১কলেরা) দেবী ওলাইচণ্ডীর মত বেরিবেরির তখন কোনো নিজস্ব দেবী ছিল না (এখন হয়েছে কিনা জানি না)৷ পাছে বেরিবেরি নামটা মুখে আনলে বেরিবেরি পায়ে চেপে বসে সেই ভয়ে কিছু কিছু মহিলা ওই নামটাই নেওয়া ৰন্ধ করে দিলেন৷
মনে আছে, ছোটবেলায় আমাদের মুঙ্গের জেলায় একবার দারুণ প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল৷ লোকে তখন আর প্লেগকে২ (২অঙ্গিকা ভাষায় গিল্টি/গিট্টি) প্লেগ বলত না৷ সবাই বলত ‘বহ্হী ৰীমারী’৷ তারপর দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করত৷
আমাদের পাড়ার গাঙ্গুলী মশায় বেরিবেরির নাম শুণে থর থর করে কাঁপতেন৷ বাড়ীতে মাত্র দু’টি প্রাণী–গাঙ্গুলী মশায় আর গাঙ্গুলী–গিন্নী৷ তাঁরা ঠিক করলেন, আগেভাগেই ডাক্তার ডেকে এনে বাড়ীতে বেরিবেরি ঢ়োকা ৰন্ধ করে দেওয়া হোক৷
ডাক্তারবাবু এসে গাঙ্গুলী মশায়ের ঘরে ঢুকলেন৷ পাশের ঘরে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন গাঙ্গুলী–গিন্নী৷ পর্দার আড়াল থেকে গাঙ্গুলী–গিন্নী জোর গলায় বললেন–কত্তা, আগে ডাক্তারকে শুধোও ওই রোগের কী কী লক্ষণ৷
ডাক্তার জোর গলায় গাঙ্গুলী মশায়কে বললেন–গাঙ্গুলী মশায়, আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন, ওই রোগ মানে কোন রোগ?
গাঙ্গুলী মশায় ডাক্তারকে বললেন–ওই রোগ মানে ৰেরিৰেরি৷
পর্দার আড়াল থেকে গাঙ্গুলী–গিন্নী মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন–কত্তা, তোমার কি ভিমরতি হয়েছে? তোমাকে সাত শ’ বার বলেছি ও নাম নিও না, একটু উল্টো করে বলো রেৰিরেৰি৷
ডাক্তারবাবু বললেন–বুঝেছি, বুঝেছি৷ ওই রোগ হলে পা ফোলে, হজম শক্তি চলে যায়, শরীর দুর্বল হয়ে যায়, চোখ খারাপ হয়ে যায়৷ এইগুলিই প্রধান লক্ষণ৷
পর্দার আড়ালে থেকে গাঙ্গুলী–গিন্নী জিজ্ঞেস করলেন–কত্তা, তুমি যে সব সময় তামাক খাচ্ছো, ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করো তামাকে ভিটামিন আছে কিনা৷ তামাক খেলে রোগ বাড়ে না তো?
ডাক্তার একটু উঁচু গলায় বললেন–গাঙ্গুলী মশায়, আপনার স্ত্রীকে বলুন ঠিকভাবে টানতে পারলে তামাকে ভিটামিন পাওয়া যায়৷ অন্যথায় পাওয়া যায় না৷
গাঙ্গুলী মশায় বললেন–ঠিকই তো ঠিকই তো, কী যেন একটা শাস্ত্রের কোথাও আছে–
‘‘তাম্রকূটং মহদদ্রব্যং শ্রদ্ধয়া দীয়তে যদি৷
অশ্বমেধসমপুণ্যং টানে টানে ভবিষ্যতি৷’’
অর্থাৎ তামাক হ’ল একটি উন্নত মানের বস্তু৷ কেউ যদি কাউকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তামাক অফার করে তাহলে গ্রহীতা যত বার টান দেবেন দাতা তত বার অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পেতে থাকবেন৷
পর্দার আড়াল থেকে গাঙ্গুলী–গিন্নী বললেন–কত্তা, ডাক্তারকে শুধোও, তামাকের মত আর কোন্ কোন্ জিনিসে ভিটামিন আছে৷ কাল থেকে তোমাকে সেই সব জিনিস খাওয়াব৷
ডাক্তার বললেন–টম্যাটোতে ভিটামিন আছে, পালং শাকে তো আছেই৷ তাছাড়া পালং শাক হার্টের রোগের ওষুধ রূপেও দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত৷
‘‘পালঙ্ক্যা মধুরা স্বাদুঃ শ্লেষ্মলা হিতকারিণী৷
বিষ্টাম্ভিনী মদশ্বাসপিত্তরক্তব্৷৷’’
ডাক্তার বললেন–তাছাড়া আপনি হাফ–বয়েল্ড ডিমও খাবেন৷ পর্দার আড়াল থেকে গাঙ্গুলী–গিন্নী রণরঙ্গিণী মূর্ত্তিতে চীৎকার করে শুধোলেন–কত্তা, পোড়ারমুখোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করো৷ তুমি বামুনের ছেলে বয়েল৩ (৩হিন্দীতে বৈল’ (বাংলা উচ্চারণ ‘বয়েল’) মানে বলদ৷) খাবে কী গো৷ সব গেল....গেল৷ এক্ষুণি ডাক্তারকে বিদায় করে দাও৷ আমি ওর পেছনে পেছনে গোবর জলের ছড়া দিতে দিতে যাব৷
সেদিন সন্ধ্যায় পাড়ার ছেলেরা বেরিবেরির হাত থেকে পাড়াকে বাঁচানোর জন্যে রক্ষেকালী পুজোর ব্যবস্থা করেছে৷ পুজোর সঙ্গে নানান ভ্যারাইটি ফাংশান অ্যাণ্ড পারফরম্যান্সের ব্যবস্থা আছে৷ ঠোঁটে সিঁদুরমাখা গায়কীরা এসেছেন৷ গায়কেরা তেমন পাত্তা পাননি৷ নানান সিন–সিনারি দিয়ে শ্মশানের দৃশ্য এঁকে প্যাণ্ডেল সাজানো হয়েছে৷ রক্ষেকালীর পুজো তো শ্মশানের দৃশ্যগুলো ঠিকভাবে না ফোটাতে পারলে বিউটিটাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ বেরিবেরির ভয়ে পাড়ার অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছেন–এসেছেন গাঙ্গুলী মশায়ও৷ সবাইকার মুখে এক কথা৷ এবার থেকে ঢেঁকি–ছাঁটা চাল খেতে হবে৷ ময়দার বদলে চোখল–মিশ্রিত আটা খেতে হবে৷ রোগটা নাকি ঢ়োকে কলে তৈরী সর্ষে তেলের ভেতর দিয়ে৷ তাই ঘানির তেলই খেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি৷
গাঙ্গুলী মশায়ের খাবার সময় হয়ে গেছে৷ তাই তিনি বাড়ী ফিরবেন৷ হঠাৎ পায়ে চটিটা গলাবার সময় আর্ত্তস্বরে রে–বি রে বি.... রে–বি রে–বি চীৎকার করে গাঙ্গুলী মশায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷ খানিকক্ষণ সেবা–শুশ্রুষা করার পর সবাই জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে গাঙ্গুলী মশায়, অত ভয় পেলেন কেন?
গাঙ্গুলী মশায় বললেন–আমার রেবিরেবি হয়েছে৷
পাড়ার ছেলেরা শুধোলে–আপনার বেরিবেরি হয়েছে কী করে বুঝলেন দাদু, আপনার বেরিবেরি হয়েছে৷
গাঙ্গুলী মশায় বললেন–আসার সময় চটিতে ভালভাবেই পা গলে ছিল, এখন আর চটিতে পা গলানো যাচ্ছে না৷ তার মানেই রেবিরেবিতে পা ফুলে গেছে৷
পাড়ার একটা ফুটবল–পাগল ছেলে এসে বললে–দাদু, ফুটবল খেলুন, বেরিবেরি পায়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না৷
ভীত–সন্ত্রস্ত–বিরক্ গাঙ্গুলী মশায় বললেন–ফুটবল খেলব ও জগতে গিয়ে৷
আরেকটা ছেলে এসে বললে–দেখি দেখি, কোন্ চটিতে আপনার পাটা গলছে না৷
এক মিনিট নিস্তব্ধ৷ এ যেন শ্মশানের স্তব্ধতা৷ তারপর ছেলেটি বললে–গাঙ্গুলী মশায়, আপনার ঠিকেয় ভুল হয়েছে৷ আপনি ভুল করে ঘোষাল মশায়ের চটিতে পা গলিয়েছিলেন৷
তা যাই হোক্, বেরিবেরিকে যেমন গাঙ্গুলী মশায় ভয়ে ভক্তিতে ‘রেবিরেবি’ বলতেন ভূতকে অনেকে ভয়ে ভক্তিতে ‘উপদেবতা’ বলে থাকে৷