নারী কল্যাণে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি

লেখক
অবধূতিকা আনন্দ গুনময়া আচার্যা

শ্রুতি লিখন ---সুভাস প্রকাশ পাল

আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের কোলাঘাট ইয়ূনিটের উদ্যোগ  গত বছর শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর শততম জন্মবার্ষিকী এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সুসম্পন্ন হয়, বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যষ্টি দাদা-দিদি এবং মার্গী ভাই-বোন ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ ঐ দিনের বৈকালিক সভায় অতিথি হয়ে আমারও থাকার সুযোগ হয়েছিল৷ ঐ সভায় অবধূতিকা আনন্দগুনময়া আচার্যার বক্তব্যটি ছিল সত্যই মনে রাখার মতো তাঁর বক্তব্যের সারমর্মটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷

এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নারীরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সমাজে তাঁরা ছিলেন  উপেক্ষিতা ও অবহেলিতা৷ কোন কোন দেশ বা সম্প্রদায়ের মধ্যে নারী শিক্ষা তথা নারী স্বাধীনতা ছিল কল্পনার বিষয়৷ নারীদের কোন ভোটাধিকার ছিল না, মেয়েরা যদি পড়াশোনা করে, তবে সমাজ গোল্লায় যাবে, বাড়িতে রান্না-বান্না বা গোরু-বাছুর দেখার লোক পাওয়া যাবে না ইত্যাদি৷ কোন কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতে নারীর ধর্মীয় অধিকার থাকা  ঠিক নয়,নারীরা মুক্তি-মোক্ষ পেতে পারে না৷ মুক্তি-মোক্ষ পেতে হলে তাকে পুনরায় মানুষের শরীর ধারণ করে পৃথিবীতে আসতে হবে৷ বস্তুতঃ নারীর মতামতকে অবদমিত করার জন্য এবং প্রকারান্তরে তাকে দাসী বানিয়ে রাখার জন্য নানা শাস্ত্র কথা শুনিয়ে তাঁদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ তাঁরাও এই বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন বা  মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ এই অবহেলিতা ও উপেক্ষিতা নারী-সমাজের প্রতি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের (ভক্তদের কাছে তিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি এই নামে পরিচিত) ছিল প্রগাঢ় সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, আনন্দমূর্ত্তিজী ঘোষনা করলেন--- নারী পুরুষের দাসী নয়, নারী ও পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের সন্তান, পিতা-মাতার কাছে তার পুত্রকন্যারা যেমন সমান আদরের বা স্নেহের পাত্র, ঠিক  সেরকম পরমপুরুষের  কাছেও নারী-পুরুষ দুই-ই সমান আদরের, কেউ ছোট বা বড় নয়৷

তবে একথা ঠিক নারীরা শারীরিক বিচারে পুরুষের চাইতে দুর্বল৷ স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য মনও তাদের কিছুটা কোমল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের কাছে তাদের মূল্য পুরুষের চাইতে এক পাই ও কম নয়, তাদের হৃদয়বৃত্তির বৈশিষ্ট্যগুলি কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না৷ তিনি প্রশ্ণ করেছেন--- বাড়ীতে কোন অতিথি-অভ্যাগত এলে কার ভাগের ভাতটা অতিথিকে দেওয়া হয়? নিজের পিত্রালয়ের পাওনা-গণ্ডার মোহ ছেড়ে দিয়ে কে বা কারা অপরের ঘর গোছাতে যায়, ছোট শিশুর  অসুখ-বিসুখ হলে রাত্রি জাগরন কাকে বেশী করতে হয় ইত্যাদি৷ পৃথিবীর অধিকাংশ মানবীয় ক্ষেত্রে একথাগুলি প্রযোজ্য, নারীর স্নেহ প্রবনতার জন্য, তার  কোমল স্বভাবের জন্য আনন্দমূর্ত্তিজী ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পঠন-পাঠনের দায়িত্ব নারীদের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছেন, তাঁর কথায় নারী-পুরুষের সম্পর্কটা প্রভু দাসের  সম্পর্ক নয়, পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক একটা সুন্দর মানবসমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে৷ তাঁর ভাষায় ‘That should be a "co-ordinated co-operation and not a Sub-ordinated one’’৷

নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে  স্বীকার করে নিয়েছেন, সংসারের প্রয়োজনে নারীরা চাকরি-বাকরি করবে, ব্যবসা-বানিজ্যও করবে৷ কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে---অতিরিক্ত অর্থের মোহ তার সন্তান-সন্ততির সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে যেন বাধাস্বরূপ না হয়ে দাঁড়ায়, নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হলে পণপ্রথার  মত অমানবিক বিষয়গুলি ক্রমশঃ সমাজ থেকে হ্রাস পেতে থাকবে৷

ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করবে৷ নারীরা তাদের সাধনা ও ঐকান্তিক ঈশ্বর প্রেমের ফলস্বরূপ মুক্তিমোক্ষ পাবে, আনন্দমার্গে পুরুষরা যেমন কোনও ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন, নারীরাও তেমন পৌরহিত্য করতে পারেন যা অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চিন্তাও করা যায় না৷ আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী উভয়কেই ধর্মপ্রচার, আর্ত-মানবতার সেবা, স্কুল কলেজে অধ্যাপনা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই সমানভাবে দেখতে পাই৷

আনন্দমূর্ত্তিজী শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে অযৌক্তির কোন বিষয়কে মেনে নেননি বা সমর্থন করেননি, তিনি ছিলেন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও সর্বপ্রকার ভাবজড়তার Dogma) বিরোধী আমাদের সমাজে বিধবা নারীদের  অনেক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না৷ তাদেরকে অকারণ অনেক  কৃচ্ছসাধনের পরামর্শ দেওয়া হয়৷ বিবাহ করতে যাওয়ার সময় হিন্দুসমাজে ছেলেদেরকে বলে যেতে হয়---‘‘মা! আমি তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি৷’’ এই সমস্ত অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার তিনি ঘোর বিরোধী৷

তিনি নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন৷ তবে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি৷ নারীরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করবে, বিদ্যাচর্চা করবে, জীবিকার প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে বের হবে৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে--- পুরুষের বন্ধু পুরুষ এবং নারীর বন্ধু নারী, পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে শালীনতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে৷ নারীরা শরীর-চর্চাও করবে৷ নারীর সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে তিনি নারীদের জন্য দিয়েছেন কৌশিকী নৃত্য, নিয়মিত কৌশিকী নৃত্যের অভ্যাসে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, সুপ্রসব হবে৷ এটি বাইশটি রোগের মহৌষধ৷

নারী এবং পুরুষ সমাজরূপী পক্ষীর দুটি পাখা স্বরূপ৷ দুটি ডানাকেই সবল হতে হবে৷ আনন্দমূর্ত্তিজীর ভাবধারায় নারীরা নিজেদেরকে গড়ে তুললে অবিলম্বে একটি সুন্দর মানবসমাজ তৈরী হবে---এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই৷