নারী–প্রগতি

লেখক
অবধূতিকা আনন্দরসধারা আচার্যা

আজকাল প্রায়ই নারী প্রগতি বলে একটা কথা অনেকের মুখে মুখে চলে আসছে৷ সেদিন রেডিও এফ. এম. গোল্ড এ প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে এই ‘‘নারী প্রগতি’’ কথাটা শুনে আমার মনে এ বিষয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা প্রকট হয়৷

মেয়েরা উচ্চ  শিক্ষিত হবে, চাকুরী স্থলে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবে, মাসের শেষে তার উপার্জনের অর্থে সংসারে সচ্ছ্বলতা আসবে, পরিচ্ছদের স্বল্পতায় অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলবে, অথবা মুখে রক্ত, লিপষ্টিক মেখে সিল্ক্ জর্জ্জেটের শাড়ী পরে কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে, আটটা আটটা অফিস করে সংসারের উপার্জন বাড়াবে আর কোন সিনেমা বা রেস্তোরঁয় গিয়ে মনোরঞ্জন করবে৷ এই অর্থে কি নারী প্রগতি কথাটা প্রযোজ্য? কিন্তু প্রগতির অর্থ এত ছোট করে, এত সংকীর্ণ করে, দেখা তো উচিৎ নয়৷

সাধারণ মানুষ প্রগতি অর্থে অগ্রগতিকে বোঝায়৷ তাদের ধারণা যে জাতি যত সভ্য বা উন্নত (আধুনিকতার দিক থেকে) সে জাতি তত প্রগতিশীল৷ তাই তারা প্রগতিকে নির্দ্দিষ্ট কোন কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে নি৷ তাদের মতে প্রগতি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বিভিন্ন রূপ নেয়৷ সেই জন্যে এক কালে যাকে প্রগতি বলে ধরে নেয়া হয়, পরবর্ত্তী কালে সেটা অচল হয়ে যায়৷ আবার অচল বা পরিত্যক্ত ব্যবস্থা অন্য কালে এসে প্রগতির অনুকূল বলে ধরা হয়৷

বলা হয়ে থাকে নারী ও পুরুষ উভয়ের স্বতন্ত্র ব্যাষ্টিসত্তা আছে৷ এই ব্যাষ্টি সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশই হ’ল প্রগতি৷ আসলে প্রগতি শব্দের প্রকৃত অর্থ হ’ল প্রকৃষ্ট রূপে যে গতি অর্থাৎ যে গতি মানুষকে পূর্ণত্বের দিকে নিয়ে চলে৷ আমি এখানে নারী প্রগতির কথা বলছি৷ উপনিষদের যুগে মৈত্রেয়ী ছিলেন প্রগতিশীলা নারী৷ মৈত্রেয়ী যে ধনে অমৃত লাভ হয় না, সে ধন হেলায় পরিত্যাগ করে অমৃত সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন৷ এটাই পূর্ণত্ব অর্জনের পথ৷ তাই তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী পূর্ণত্বের দিকে নিয়ে চলে৷ ‘‘যেনাহম্ নামৃতা স্যাম কিমহম্ তেন কুর্যাম?’’ আজও এ বাণী অমর হয়ে রয়েছে৷

এখানে অমৃত মানে যা পান করলে মানুষ অমর হয় এই অর্থে নয়, এখানে অমৃত অর্থে পরমপুরুষ, যাঁকে লাভ করলে মানুষ অমৃতত্ত্ব প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ পরমপুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যায়৷ তাই মৈত্রেয়ী বলেছিলেন, যে ধনে অমৃত লাভ হয় না অর্থাৎ যাতে পরমপুরুষ মেলে না সেই ধনে আমার কি প্রয়োজন? তাই তিনি অমৃত বিহীন ধন (অর্থাৎ বাহ্যিক ধন, সম্পদ) হেলায় পরিত্যাগ করে অমৃত সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন৷

ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের দায়িত্ব নারীর৷ যুগের পরিবর্তন হয়ে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়ে চলেছে৷ তাই সেই বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সঙ্গে নারীকে যুক্ত হতে হবে৷ নারীর মূর্তি শাশ্বত মাতৃমূর্ত্তি–সে সেবাময়ী, স্নেহময়ী, কল্যাণময়ী, করুণাময়ী৷ যদি কোন শিক্ষা তার হূদয়ের এই সহজাত কোমল বৃত্তিগুলিকে নষ্ট করে দেয় তবে সে শিক্ষা অবশ্যই নারীর বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাজ্য৷ আবার নারীর যদি কেবলমাত্র তার হূদয়ের কোমল বৃত্তিগুলিরই চর্চ্চা করে, তার বর্তমান বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বা শিক্ষা ব্যাবস্থায় নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারে ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট না হয় তবে তার প্রগতি হবে ব্যাহত৷ তাই নারীর হূদয়ের কোমল সহজাত বৃত্তিগুলির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার ও আধ্যাত্মিক সাধনার সমন্বয় সাধন ঘটাতে হবে নারীকে৷ জাতীর ভবিষ্যৎ কর্ণধারগণকে উপযুক্ত নাগরিক করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব নারীর৷ আবার সংসারের শান্তি রক্ষার ও শ্রীরক্ষার দায়িত্বও নারীর৷ যদি নারী তার শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে না পারে, তবে এ দায়িত্ব সে কখনই ঠিকমত পালন করে উঠতে পারবে না৷

জীবনের অর্থনৈতিক মান অনেকখানি নেমে গেছে৷ তাকে ডঁচু করে তোলার জন্যে পুরুষের পাশে এসে নারীকে অর্থ উপার্জ্জনে সাহায্য অবশ্যই করতে হবে৷ রাষ্ট্রের ও সমাজের অধিবাসী হিসাবেও নারীর কর্তব্য অবশ্যই আছে৷ মানুষের মানবিক বোধ, নৈতিক বোধ ও আধ্যাত্মিক বোধকে জাগ্রত করতেও নারীর ভূমিকা আছে৷ এই সমস্ত কর্ত্তব্য যে সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে সক্ষম হবে সেই হবে প্রগতিশীল৷

বর্তমান নারী সমাজ যে পথে চলেছে, তাকে প্রগতি বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ বৃহত্তর মানব সমাজে শিক্ষায়, সাহিত্য, দর্শনে, রাজনীতিতে, বিজ্ঞানে কোন ক্ষেত্রেই নারী আজ পিছিয়ে নেই৷ এমন কি অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে নারী অনেক এগিয়ে আছে৷ সুযোগ সুবিধা পেলে সর্বক্ষেত্রেই নারী তার প্রতিভার পরিচয় দিতে পারে৷ দুরূহ ব্রহ্মবিদ্যায় নারী আজ পিছিয়ে নেই আর অতীতেও ছিল না৷ সেকথা আমরা মৈত্রেয়ীর মুখনিঃসৃত বাণী থেকে জ্ঞাত হয়েছি৷ তারপরও বলছি নারীহূদয় মাতৃ হূদয়–স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, দয়ামায়া, সেবা সহানুভূতি, ঈশ্বর ভক্তিতে পরিপূর্ণ৷ মানুষের সমস্ত কোমল বৃত্তির আধার নারী হূদয়৷ বিধাতা তাকে এভাবেই তৈরী করেন৷ তাই বলছিলাম কি বাইরে জগতে নিজের স্থান করতে যদি তাকে গৃহের সম্বন্ধ ভাঙ্গতে হয়, তার পারিবারিক পরিবেশ অশান্তির অনলে জ্বলে ওঠে, তবে তা প্রগতি হতে পারে না৷ যার মধ্যে কল্যাণ নেই তা কখনও প্রগতি নয়৷

যে কাজ সংসারে কল্যাণ আনে, যে কাজের দ্বারা সমাজে দ্রুতি আসে, কল্যাণ হয় যা বিশ্বমানবের কল্যাণে নিয়োজিত৷ যে কাজ আত্মিক কল্যাণ ঘটায় ও যার দ্বারা মানুষ মুক্তির সন্ধান পায়, সেই পথই প্রগতির পথ৷ বিশ্বের সমস্ত নারী যদি সেই পথে চলতে পারে তবে এ বিশ্ব হবে স্বর্গের সমান৷ আমি সমস্ত বিশ্ব নারীর কাছে আহ্বান জানাই, হে মাতৃজাতি ওঠো, জাগো, দেখো, আমরা সবাই অমৃতস্য কন্যা৷ আমাদের জাগরণ ঘটলেই বিশ্ব মানবতার জাগরণ ঘটবে৷ আমি আবার স্মরণ করছি মৈত্রেয়ীর কন্ঠের চির সত্যের বাণী ‘‘যেনাহম্ নামৃতা স্যাম কিমহম্ তেন কুর্যাম?’’ শুধু দিন যাপনের গ্লানির মধ্য দিয়ে নয়, বৃহৎকে অমৃতকে লাভ করে আমাদের নারী জন্ম সার্থক করতে হবে৷