ভারতের স্বাধীনতার মুক্তি সূর্য, ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করার মূল কান্ডারী, মহান বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যে মহান বানী উৎসর্গ করেছেন তাহা হলো---’’ পৌরুষের বজ্র কৌস্তব... রাজনীতির জ্বলন্ত ধুমকেতু... উল্কার অনলশিখা, সেই সুভাষচন্দ্রও ছিলেন বংশধারা সূত্রে রাঢ়ের মানুস৷’’ তার জন্মের ১২৫ বছর পর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নানা রকমের লোক দেখানো অনুষ্ঠানের অবতারনা করেছেন৷ আজকের নব প্রজন্ম জানতেই পারলেন না নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের স্বাধীনতার পূর্বে ভারতের মাটিতে ও বিদেশে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তার উদ্দেশ্য কী? আজকের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে তার কোন মিল নেই৷ তিনি ভারতের তৎকালীন বৃদ্ধ নেতৃত্বকে বারবার বলেছিলেন ব্রিটিশ সূর্য প্রায় অস্তগামী, আগামীতে স্বাধীন ও সমৃদ্ধ ভারত গড়তে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খুবই জরুরি৷ তৎকালীন বৃদ্ধ নেতৃত্ব ভেবে ছিলেন ২০০ বছরের পরাধীন ভারত আবার কতদিনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে তার ঠিক নেই, ততদিনে আমরা মরে ভূত হয়ে যাবো৷ দরকার কী অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আর একটি আন্দোলন৷ যাহা পাই গদীতে বসে লুটে পুটে খাই, তার জন্য ভারতবর্ষ কত টুকরো হবে বা কত মানুষ ঘর ছাড়া হবে তাহা আমাদের জানার প্রয়োজন নেই, গদীটাই মূল বিষয়৷
ইতিহাস বলছে ভারতের স্বাধীনতায় সব থেকে বেশি রক্ত ও শ্রম দিয়েছিলো বাঙলা ও পঞ্জাব৷ পাশাপাশি ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ববর্গ ছিলো মধ্য, উত্তর, পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতের৷ শুধু তাই নয়৷ এদেরকে ব্রিটিশের অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি৷ এই কপট নেতারা আর্থিকভাবে ছিলো স্বাবলম্বী, তাদেরকে দেশ ভাগের বলি হয়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরিতও হতে হয়নি৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিক আইনে পূর্ব পাকিস্তান বা বাঙলাদেশ থেকে যারাই এসেছে তাদেরকে এত বছর বসবাস করার পরও বর্তমান সরকার তথা আমরা বাঙালী বাদে সব কটি রাজনৈতিক দলই তাদেরকে বিদেশি, বহিরাগত, ঘুচপেটিয়া ইত্যাদি অপমান সূচক কথা বলে গালাগাল দিচ্ছে৷ কারণ বাঙালীরাতো নেতাজীর বংশধর৷ তাছাড়া বাঙালীরা চিরকালই আন্দোলন প্রিয় হওয়ায় ও যে কোনো মুহুর্তে দিল্লীর সম্রাটকে উল্টে দিতে পারে৷ মূলত এই ভয়েই বাঙালীকে নাগরিকত্বের নামে অথবা নানা অছিলায় চাপে রাখাটাই ছিল কেন্দ্রের কাজ৷
অন্যদিকে নেতাজীর আদর্শ ও চিন্তা কতো স্বচ্ছ ছিলো তা একটি ঘটনায় প্রমাণ করে ৷ ঘটনাটি হলো, নেতাজী যখন রেঙ্গুন আজাদী হিন্দ ফৌজ তৈরী করতে ব্যস্ত তখন সেনাবাহিনীর কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়৷ সেই সময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতীয়রা ও ব্রিটিশ বিরোধী জনগণ সেই কাজে আর্থিক ও নানা ভাবে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে৷ ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে রেঙ্গুন শহরের একজন বিত্তশালী মানুষ যিনি একটি গুজরাটের হিন্দু মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত, তিনি নেতাজীকে ফৌজ তৈরী করাতে আর্থিক সাহায্য করতে চাইলেন৷ তখন তিনি একটি শর্ত দিয়েছিলেন--- নেতাজীকে রণ সজ্জ্বায় মন্দিরে গিয়ে অনুদানটি গ্রহণ করতে হবে৷ নেতাজী তার উত্তরে বলেছিলেন দান বা অনুদান কখনো শর্ত সাপেক্ষ হয় না৷ নেতাজী আরো বললেন আমি সুভাষ বসু হয়ে যেতে পারি, তাতে অনুদানটি আজাদহিন্দ বাহিনীর নামে হবে না৷ নেতাজী হয়ে গেলে আমার সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রীষ্টান ধর্মীয় বিশ্বাসের ফৌজ থাকবে আপনারা কি তাদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দেবেন৷ এই কথা শুনে বিত্তশালী মানুষটি একটু চুপ থেকে বললেন আগামীকাল মন্দির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য কি তা তিনি জানাবেন৷ পরের দিন মন্দির কমিটির কয়েকজন প্রবীণ সদস্য নেতাজীর ইচ্ছের সব কিছুই মেনে নিয়ে তারা মন্দিরে কবে ও কখন যাবেন ঠিক করে চলে গেলেন৷ আগে ওই মন্দিরটিতে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের প্রবেশের অধিকার ছিল৷ কিন্তু নেতাজীর কথা অনুযায়ী ওইদিন থেকে সকালের প্রবেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়৷ নেতাজী প্রবেশপথে দেখতে পান শত শত বিভিন্ন মতাবলম্বী ভারতীয়রা ওই মন্দিরে প্রবেশ করছে৷ তিনি তার বক্তব্যে কবির মহান বানী উল্লেখ করে বলেছিলেন নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান৷’’ এই হল ভারতবর্ষের চিত্র৷ বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের দৌলতে ভারত আজ ধর্মীয় মতবাদের বেড়াজালে একদিকে রক্তের বন্যা, অপরদিকে জাতপাতের নামে প্রতি হিংসাত্মক তৎপরতা, নানা বর্ণের নামে ভারতবাসী আজ হাজার ভাবে বিভক্ত হওয়ার জন্য ভারতের অধিকাংশ মানুষ আজ দমন পীড়ন ও শোষণের যুবকাষ্ঠে বলি হচ্ছে৷ ভারতবর্ষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাওয়ায় আজো স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতের মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের দৌলতে ভারতের অধিকাংশ মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে বিকলাঙ্গে পরিণত হয়েছে৷ পাশাপাশি মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার আজ অর্থনৈতিকভাবে ধনসম্পদের চুড়ায় বসে সাধারণ মানুষের হাড়মাংস সহ মানবিক মূল্যবোধকে লুটেপুটে খাচ্ছে৷ নেতাজী তার তরুণের স্বপ্ণে বলেছেন ‘‘নব প্রজন্মকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হলে সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামের কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ছোটো ছোটো শিল্প তৈরী করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করতে হবে৷ তিনি আরো বলেছেন--- আর্থিক উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের মানুষকে জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷
আজকের রাজনৈতিক নেতারা ব্যষ্টি পুঁজিবাদী ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ধারায় প্রভাবিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটাই আজ দায় হয়ে উঠেছে৷
ব্রিটিশ ভারতের নেতৃত্বের অদূরদর্শীতা ও নেতাজীর আদর্শের প্রতি কঠোর মনোভাবকে উৎসাহিত না করে তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখায় সাধারণ মানুষ আজ সকল দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে৷
মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর যুগান্তকারী ‘‘প্রাউট’’ দর্শনে বলেছেন--- রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক ধোঁকাবাজ নয় চাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র৷ কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে কৃষি ভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার সাথে সাথে সমবায়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ হলেই মানুষ শোষণের রাজনীতি বন্ধ হবে৷ এর ফলে সার্বিকভাবে মানুষের বিভিন্ন স্তরীয় শোষন বন্ধ হবে ও মানুষের বেঁচে থাকার কৌলিন্য আবার ফিরে পারে৷
- Log in to post comments