নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রকৃত পথ– প্রাউট

লেখক
পথিক বর

পথিক বরমহাকালের কালচক্রে দিন, মাস, বছর নিয়মিত আসে যায়৷ কিন্তু এরই মধ্যে বছরের এক একটা দিন এমনই স্মরণীয় হয়ে থাকে যে, আমরা এটিকে পবিত্র দিন হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হই৷ এমনি একটা পবিত্র দিন ২৩শে জানুয়ারী–নেতাজী জয়ন্তী৷ এই দিন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পুন্য জন্মদিন, যিনি আজীবন দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্যে কঠোর তপস্যা করে গেছেন৷

নেতাজী নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করেননি৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন৷ ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে এক ভাষণে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তি অর্জন করছে৷ এদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷

এই উক্তির কারণেই সুভাষচন্দ্রকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে সাথে দেশীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে৷ ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মূলতঃ  জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিম ভারতীয় নেতাদের চক্রান্তের ফলে৷ কারণ দেশীয় পুঁজিপতিরা অধিকাংশই পশ্চিম ভারতীয়৷ আজও যে সব পুঁজিপতিরা লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে তাদের প্রায় সবাই পশ্চিম ভারতীয়৷

আজও আমরা প্রকৃতপক্ষে নেতাজীর স্বপ্ণের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করিনি৷ ব্রিটিশের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পাইনি৷ তাই আজও এখানে ক্ষুধার তাড়নায় মা তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়৷ অভাবের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে হয় হাজার হাজার দরিদ্র মানুষকে৷

নেতাজী চেয়েছিলেন, পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটিয়ে আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে ঠিকই কিন্তু সেই সমাজতন্ত্র মার্ক্সীয় জড়বাদী সমাজতন্ত্র নয়৷ নেতাজীর নিজের ভাষায়– ‘‘সে সমাজতন্ত্র কার্লমার্ক্স–এর পুঁথির পাতা থেকে জন্ম নেয়নি, এর উৎপত্তি ভারতবর্ষের আপন চিন্তাধারা  ও সংস্কৃতির মধ্যে৷’’ তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সুষম সমন্বয়৷

নেতাজীর চিন্তাধারার এই অভিনব দিকটা আমাদের দেশনেতারা, এমনকি বর্তমানে দেশের অর্থনীতিবিদ্ বা বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ঠিক ঠিক বুঝতে পারেন নি৷ নেতাজী তাঁর এই নোতুন চিন্তাধারাকে তাঁর বিভিন্ন রচনার মধ্যে সুস্পষ্ট রূপে ব্যক্তও করেছেন৷ নেতাজী বলেছেন, ‘‘আমাদের (ভারতের) গৌরবোজ্জ্বল যুগগুলিতে আত্মা ও দেশের, চৈতন্য ও জড়ের দাবীর মধ্যে একটা মধ্যপথ বা সমন্বয় বের করা হয়েছিল৷ এর ফলে দুই ক্ষেত্রেই একই সঙ্গে সমান অগ্রগতি হতে পারে৷ আত্মার ও দেহের মধ্যে এমন এক পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে যার দরুণ দেহকে তুচ্ছ করলে যে দেহেরই ক্ষতি হয় তা নয়, পরিণামে অধ্যাত্মজীবনেও মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে৷ আজকাল ভারত কেবল দৈহিক শক্তিহীনতা নয়, আধ্যাত্মিক ক্লান্তিতেও ভুগছে৷ এটা আমাদের জীবনের একটা দিককে তাচ্ছিল্য করার পরিণাম৷ যদি আবার আমাদের আত্মমর্যদা ফিরে পেতে হয়, তবে দৈহিক ও আত্মিক–দুই ক্ষেত্রেই আমাদের একই সঙ্গে এগুতে হবে৷’’

অর্থাৎ নেতাজী চেয়েছিলেন, জাগতিক ও আত্মিক–উভয় ক্ষেত্রেরই সমান্তরাল উন্নতি৷ আর এইভাবে সমাজের যথার্থ অগ্রগতি সম্ভব৷ এটাই নেতাজীর ‘সমন্বয়বাদ’৷

বলা বাহুল্য, বর্তমানে ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলই নেতাজীর এই অভিনব চিন্তাকে উপলব্ধিই করতে পারেনি৷ আর এই কারণে, সবাই অন্ধকারে হাতড়িয়ে চলেছে, সবাই দিশাহারা৷ আর তারই ফলশ্রুতিতে সমাজের সার্বিক অবক্ষয়–সার্বিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷

এখানে সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে কেউ যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করে, তাহলে সে দেখবে নেতাজীর স্বপ্ণ একমাত্র ‘প্রাউটে’ই মূর্ত হয়ে উঠেছে৷ কারণ, সর্বপ্রকার কুসংস্কার ও শোষণমুক্ত আধ্যাত্মিক ভিত্তিভূমির ওপরেই গড়ে উঠেছে প্রাউটের ‘প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের’ ইমারত৷ প্রাউট–প্রবক্তা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত নীতিবাদী বিপ্লবী চেতনাসম্পন্ন মানবগোষ্ঠীই আজ পারে প্রকৃত প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে৷ প্রাউট প্রবক্তা এঁদের নাম দিয়েছেন–‘সদ্বিপ্র’৷ এরাই পারে বিশ্বের সমস্ত মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারান্টী দিতে, সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে জীবনের আত্মিক চরিতার্থতার পথে এগিয়ে নিয়ে চলতে৷

আজ নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রকৃত পথ হ’ল, নেতাজীর আদর্শকে যথাযথরূপে বুঝে তাঁর স্বপ্ণকে সার্থক করার জন্যে শপথ নেওয়া৷ আদর্শ মানব সমাজ গড়ার লক্ষ্যে নোতুন উদ্যমে এগিয়ে চলা৷ আদর্শ মানব সমাজ গড়ার সুনির্দিষ্টি পথ নির্দেশনা আছে প্রাউটে৷