নেতৃত্বের সংকট ও সমাধান 

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বহু দলীয় গণতন্ত্রে নেতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ যদিও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলা হতে থাকে জনগণের জন্যে-জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার৷ সার্থক গণতন্ত্র তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্রের কমপক্ষে ৫১ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত ও সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন হবে৷ ভারতবর্ষে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের একটা বড় অংশ আজও সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিষয়ে শুধু অসচেতন নয়, অজ্ঞ বলা চলে৷ এই অবস্থায় ভারতীয় গণতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ দলের দ্বারা, দলের জন্যে, দলের সরকার৷ আবার দল নির্ভর করে ব্যষ্টি নেতৃত্বের ওপর৷ তাই ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যষ্টি নেতৃত্বকে অস্বীকার করা যায় না৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যষ্টি নেতৃত্বের কু-ফল ভারতবাসীকে স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও ভোগ করতে  হচ্ছে৷ আজও সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা সমস্যার অন্যতম কারণ ব্যষ্টি নেতৃত্বের ত্রুটি-অহঙ্কার স্বার্থলোভ ও ক্ষমতার মদমত্ততা৷ এই পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব নিয়ে দু’চার কথা বলা প্রয়োজন মনে করি৷

পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুল সমান দুই ভাগে বিভক্ত৷ এককচারী ও যূথবদ্ধ৷ যূথবদ্ধ জীবেরা কখনোই একা থাকতে পারে না৷ একজন আর একজনকে দেখলেই কাছাকাছি চলে আসবেই৷ হাতী, ভেড়া প্রভৃতি এই ধরণের যূথবদ্ধ জীব৷ একসঙ্গে যেতে যেতে যদি একটা ভেড়া গর্তে পড়ে তো সব ভেড়া সেই গর্তে গিয়েই পড়ে৷ তাই ভেড়ার পালের গতিকে বলা হয় গড্ডালিকা প্রবাহ৷

মানুষও যূথবদ্ধ জীব৷ কোনও একজন মানুষ বেশীক্ষণ একা থাকতে পারে না৷ একা থাকলেই বলতে শোনা যায়---‘আর পারি না বাবা! একা থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে৷’ বেশীক্ষণ একা থাকলেই আর একজনের সঙ্গ পেতে প্রাণ-মন আকুপাকু করে৷ যূথবদ্ধ মানুষ একসঙ্গে থাকলেও সবার শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, মেধা, বুদ্ধি সমান নয়৷ যে মানুষ এইসব গুণগুলোয় অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকে, যূথবদ্ধ সমাজে তাকে সবাই নেতা বলে মেনে নেয়৷ তাই যূথবদ্ধ সমাজকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে উপযুক্ত নেতার প্রয়োজন হয়৷ মানুষও তার প্রয়োজন ও স্বার্থের তাগিদে সেই নেতৃত্বকে স্বীকার করে নেয়৷ এই নেতৃত্বকে মানতে গিয়েই সমাজে ব্যষ্টিপূজা শুরু হয়৷ এর ফলে ব্যষ্টি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়৷ এই ব্যষ্টিপূজা অনেকেই পছন্দ করেন না৷ তবু নেতৃত্ব দেবার গুণ যার মধ্যে থাকে সমাজ তাকে নেতা রূপে মেনেই নেয়৷ তাই সমাজে ব্যষ্টিপূজা চলছে, চলবেও৷

এখন এই নেতা নির্বাচনে মানুষকে অনেক বেশী সচেতন হতে হবে৷ নতুবা হিতে-বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ নেতৃত্বের দোষে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসে৷ ইতিহাসে অনেক ধবংসের কারণ, অনেক বিপর্যয়ের কারণ ব্যষ্টি নেতৃত্বের ত্রুটি অথবা দানবীয় স্বভাব৷

মহান দার্শনিক ও প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রাউট দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে ---‘নেতা চিনতে হবে তার বিদ্বত্তা, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, অগ্রগামীতা, ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রাস্তুত্য ইত্যাদি গুণ দেখে৷’ কারণ সমাজে দৃঢ় সংরচনা, যূথবদ্ধ জীবনের শৃঙ্খলা, সব কিছু নির্ভর করে বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের ওপর৷ উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সমাজ সংরচনা জীর্ণ-দীর্ণ হয়ে যেতে পারে, যূথবদ্ধ জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে৷ ব্যষ্টির খেয়াল-খুশীতে, ব্যষ্টির ঔদ্ধত্বে জনসাধারণকে দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়৷

ব্যষ্টিতন্ত্রের এই ত্রুটির ফলেই সমাজে যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়৷ বর্তমান শাসনতন্ত্রে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এই যৌথ নেতৃত্বকে বলা হয় গণতন্ত্র৷ কিন্তু এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দৃঢ়চেতা, সৎ, নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ নেতৃত্বের যখন অভাব হয় তখন গণতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়৷ দলীয় ক্যাডার-কর্মী, চ্যালা-চামুণ্ডাদের মর্জি-মাফিক জনগণকে চলতে হয়৷ ক্যাডার-কর্মীদের খেয়াল-খুশীতে জনগণকে অযথা অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়৷

তাই কি ব্যষ্টি একনায়কতন্ত্র, কি গণতন্ত্র দৃঢ়চেতা সৎ, নেতৃত্বের অভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বাঁধে৷ পাশবিকতার প্রকাশ ঘটে৷ তাই সমাজে একান্তভাবে প্রয়োজন আদর্শ নেতৃত্ব৷ প্রাউট তথা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সদ্‌বিপ্র সূত্র বর্তমান নেতৃত্বের সংকটের সমাধানের পথ দেখিয়েছে৷ শারীরিক সক্ষম, দৃঢ়চেতা ও আধ্যাত্মিক  নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত সদ্‌বিপ্রই আদর্শ নেতৃত্ব দিয়ে  সমাজকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷