পূর্ব প্রকাশিতের পর
নইকো অবলার ‘ভারতীয়’ সমাজে নারীর অবদান শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনায় প্রাচীন যুগের মধ্যে বৈদিক যুগে নারীদের নিয়ে আলোচনা আমরা শেষ করেছি, তাতে ধারা অনুযায়ী দেখতে পাই যে প্রথম দিকে নারীরা সমাজের সবক্ষেত্রেই তৎপর ছিলেন৷ ধীরে ধীরে তাঁদের উপর বিভিন্নভাবে সামাজিক বিধি নিষেধ আরোপিত হতে শুরু করে এবং সংহিতার যুগে নারীদের থেকে বিশেষতঃ সমাজের সাধারণ স্তরের নারীদের থেকে প্রায় সমস্ত রকম অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে--- তা একেবারেই খর্ব হয়ে গেল৷ তাদের কাজ হয়ে দাঁড়ালো শুধু গৃহকর্ম সন্তান উৎপাদন ও পালন-স্বামী পালন শ্বশুর বাড়ীর সেবা করা, শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, ‘‘নারী তার স্বামীর পথে চলবে৷ ‘‘নারীকে শৈশবে পিতা রক্ষা করে, যৌবনে স্বামী রক্ষা করেন এবং বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করে৷ স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্যের অধিকার নেই, (মৈত্রায়নী সংহিতা ১/১০/১১)
অগ্ণিবৎ অনুষ্ঠানে হবিকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, ঠিক তেমনি ভাবের পত্নীকে প্রহার করা উচিত, যাতে তার নিজের শরীরের উপর বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকে, (শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/১৩) নারী হয়ে দাঁড়ালো পণ্য, তার দেহ, তার শ্রম তার প্রভুর ভোগের জন্য তাই তাকে বন্ধক রাখা যেত, কেনা যেত, বিক্রি করা যেত, তা যজ্ঞের দক্ষিণা হিসেবে, যৌতুক হিসাবে বা অতিথির উপহার হিসাবে দানও করা যেত৷ সংসারে স্ত্রীদের কোন বিশেষ সম্মান থাকত না৷ এক একজন পুরুষ বহু নারী বিবাহ করতেন, শতপথ ব্রাহ্মণে আছে যে---‘‘সমৃদ্ধি তারই যে পুরুষের পশুপালনের চেয়ে স্ত্রীরা সংখ্যা কম৷ যে স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করে তার কঠোর৷ হতে পারে৷ কিন্তু যে স্ত্রী-দণ্ড স্বামীকে ত্যাগ করে, প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা তার শুদ্ধি হয়৷
যে স্বামী স্ত্রীর প্রতি কটুভাষণ করে সেই স্ত্রীকে উপবাস ও প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়৷ বন্ধ্যা নারী দশ বছর পরে আইনত পরিত্যাজ্য হতেন, যে নারী মৃতবৎসা বা শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়, সে বারো বছর পর পরিত্যাজ্যা হতোও পরায়না তৎক্ষণাৎ পরিত্যজ্য (মনুসংহিতা-৯/৪) কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শুদ্র ও নারী হত্যার প্রায়শ্চিত্ত মাত্র একদিনের (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১/৯/২৩,৪৫)৷ স্বামীকে বলা হয়েছে খাবার পরে স্ত্রীকে উচ্ছিষ্টটি দিতে৷ (গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১)৷
মহাকাব্যগুলিতেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই৷ মহাকাব্যের নারীরা প্রধানতঃ অন্তঃপুর বাসিনি দূত ক্রীড়া সভায় দ্রৌপদীকে রাজ্যের আর পাঁচটা সামগ্রীর মতো বাজি রাখা হয়েছিল৷ তরুণী রাজকন্যা মাধবীর উপাখ্যান আমাদের চোখ খুলে দেয়৷ তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজের উচ্চ বর্ণের নারীদের স্বাধীনতা ছিল৷ যেমন---স্বয়ম্বর প্রথা কখনও কখনও পরামর্শ দিবার জন্য নারীরা সভাতে আহুতা হইতেন৷ গান্ধারীকে এইরূপ সভাতে মন্ত্রণার্থে আহ্বান করা হয়েছিল৷ (উদ্যোগ ৬৭-৬)
দেবী গান্ধারী ছিলেন মহাপ্রজ্ঞা বুদ্ধিমতী, ‘আগমনাপায় তত্ত্বঞ্জা’ (আশ্রম, ২৮,৫) ধর্মপ্রাণা গান্ধারীর আপন পর বলে কোন সংকীর্ণতা ছিল না৷ সত্যধর্ম রক্ষা করার জন্য নিজের পুত্র পাপী দুর্র্যেধনকে ত্যাগ করার জন্য তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বার বার অনুরোধ করেছেন---
‘‘তষ্মাদয়নং মদ্বচনাৎ ত্যজতাং কুলপারসনঃ’’ সভা (৭৫/৬)
যুদ্ধে মৃত দুর্র্যেধনের দেহের পাশে দাঁড়িয়ে গান্ধারী বলছেন---‘‘যুদ্ধে যাবার আগে সে আমার কাছে জয়ের আশীর্বাদ চাইতে এসেছিল
(অস্মিন্ জ্ঞাতি সমুদ্ভমে যে জয়মস্বমা ব্রতীনু মে ১১/১৭/৫)
পারিনি দিতে বলেছিলাম সে পক্ষ ধর্ম, জয় সেই পক্ষেই৷’’
ক্ষত্রিয় কন্যা বিদুলা বহুবেদ অধ্যয়ন করে বিশ্রুতা ও বহুশ্রুতা তপস্বিনী হয়েছিলেন৷
‘‘ক্ষত্রধর্মরতা দান্তা বিদুলা দীর্ঘদর্শিনী৷
বিশ্রুতা রাজসংসৎসু শ্রুতবাক্যা বহুশ্রুতা৷৷
(উদ্যোগ ১৩৩.৩)
মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে ১৩৩ থেকে ১৩৬ পর্যন্ত পুরোপুরি চারটি অধ্যায়ই বিদুলার অগ্ণিময়ী বীরবাণীতে ভরা, নিজের পুত্রদের বীর্যভাব দেখে তাঁর যে বজ্রসার বাণী তা চিরদিনে সব মানবের অন্তরে ধবনিত হতে থাকবে---
‘‘মাত্মানমবন্যস্ব মৈনমল্পেন বীভরঃ
মনঃ কৃত্বা সুকল্যাণাং মা ভৈন্ত্বং প্রতি সংহর (উদ্যোগ ১৩৩/৭)
আপন আত্মাকে অপমান করিও না, অল্পে আত্মাকে পূর্ণ করিতে যাইও না ভয় ছাড়, সুমহৎ কল্যাণের জন্যে মনকে মুক্ত কর৷
তাঁর আরও একটি কথা মন কেড়ে নেয় যে---
‘‘রাশিবর্ধন মাত্রং স নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমান্
(উদ্যোগ ১৩৩/১৮)
অর্থাৎ মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে, শুধু সংখ্যাগত আধিক্য অথবা বাহুল্য দিয়ে নয়, সজাতির কন্যা মাধবী ছিলেন৷ বহু গন্ধর্ব দর্শনা, ‘‘গন্ধর্বানাং দর্শনং শাস্ত্রং গীত বিদ্যাদি যস্যাম সা’’
(উদ্যোগ পর্ব ১১৬/৩)
পিঙ্গলা নামে এক বারনারীর কথা মহাভারতের শান্তিপর্বে আছে৷ পিঙ্গলার গাথার কথা মোক্ষধর্ম পর্বে ভীষ্মের মুখে শুনতে পাওয়া যায় (১৭৪ অধ্যায়) তার শ্রোতা যুধিষ্ঠির, এই পিঙ্গলাই একদিন আশা নিরাশা জয় করে পরম শান্তি লাভ করেন৷
নারীদের সেই যুগে যেমন সংসার ধর্ম তেমনই মানুষোচিত তেজস্বিতা, তেমনি জ্ঞান ও ধর্মের সাধনা দেখা যায়৷
ভীষ্মের দ্বারা নিগৃহীতা কাশীর রাজকন্যা অম্বা, তপস্যা করতে বনে যান৷ পুরুষদের মত নারীরাও এমন সংসার ধর্ম পালন করার পর বানপ্রস্থ অবলম্বন করতে পারতেন৷ সত্যবতী পূত্রবধুদের নিয়ে বনে গমন করেন (আদি ১২৮.১২) গান্ধারীও ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বনে গিয়ে শেষ জীবনের তপস্যা পূর্ণ করেন (আশ্রম বাসিক ১৫ অধ্যায়) সত্যভামা প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের পত্নীরাও বানপ্রস্থ আশ্রয় করেই জীবনকে সার্থক করেন৷ (মৌষল পর্ব ৭.৭৪) (ক্রমশ)
- Log in to post comments