ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, অতীতে যখনই কোন নূতন আবিষ্কার বা আদর্শ মানব সমাজের যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চেয়েছে তখনই সেই আদর্শের বিরোধিতায় যুথবদ্ধ হয়েছে সমস্ত অশুভশক্তি৷ পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে আঁকড়ে ধরে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দীর্ঘায়িত করার চক্রান্তে সামিল হয়েছে তারা৷ নূতনের বার্র্তবহ, ধারক-বাহকের ওপর চলেছে অশেষ নির্যাতন,নিপীড়ন,প্রাণঘাতী অত্যাচার---এমনকি নেমে এসেছে অকাল মৃত্যুর নিষ্ঠুর আঘাত৷ গ্যালিলিও, সক্রেটিস,যীশুখ্রীষ্ট, হজরত মহম্মদ কিংবা মহাসম্ভূতি সদাশিব ও শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে৷ আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও৷ বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের সমাজ জাত-পাত ধর্মমত, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ভেদে শতধা বিভক্ত৷ এই বিভাজনের ফলে মানুষে মানুষে সংঘাত, গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ সমাজের ভিতকে ক্রমশঃ দুর্বল করে চলেছে আর এর সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ শোষকের দল মানব সমাজের চরম সর্বনাশ করতে উদ্যত৷ কোথাও তথাকথিত ধর্মমতের চুড়ান্ত আগ্রাসন,কোথাও দাম্ভিক রাষ্ট্র-নায়কের সমগ্র পৃথিবীতে হিংসা ও সন্ত্রাসের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে৷ লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল নরনারী শিশুর দল সহায় সম্বলহীন হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বত, দুস্তর মরু অঞ্চল, প্রতি মূহূর্তের মৃত্যুর হাতছানি দেওয়া উত্তাল তরঙ্গমালাধৃত জলধির বুকে ভেলা ভাসিয়ে---শুধুমাত্র একটুকু নিরাপদ শান্তির আশ্রয়ের খোঁজে৷ একদিকে তথাকথিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধদের আস্ফালন, অন্যদিকে পুঁজিবাদী জড়বাদী আর্থিক-সামাজিক দর্শনের দুরভিসন্ধিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, সমস্যা জর্জরিত৷ পার্থিব সম্পদের অসম বন্টনে মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদের চূড়ায় বসে আমোদ-প্রমোদে মত্ত আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণা,রোগভোগের তাড়নায় যন্ত্রনাক্লিষ্ট৷ এর সঙ্গে যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের রণদামামা---পারমাণবিক, রাসায়নিক মারণাস্ত্রের বল্গাহীন প্রতিযোগিতা৷ আর একশ্রেণীর কপটাচারী দুর্নীতির ধবজাধারীরা শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে সদাব্যস্ত---তাদের ভাবখানা এই, যে যা করে করুক, আমরা আমাদের আখের গোছাই যাতে আমাদের সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতিরা দুধে ভাতে থাকে সারাজীবন৷ অথচ কোটি কোটি মানুষ অনাহার, অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর কবলে নিরুপায় হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কু-সংস্কার ও সর্বগ্রাসী ভয় তাদের নিত্যসঙ্গী৷ এই বিভিন্নমুখী সংঘাতের ফলশ্রুতিতে সমগ্র মানব সমাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ক্রমশ ধবংসেররসাতলে নিমজ্জমান!
এই যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হলেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি লক্ষ্য করলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো কুসংস্কার, ভাবজড়তা ও তথাকথিত ধর্মমত বা ইজমগুলির গোঁড়ামি---যার ফলে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, হানাহানি ও হিংসা-সন্ত্রাস৷ পৃথিবীতে যত ভয়ানক যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে তার বেশীরভাগেরই কারণ এই ধর্মান্ধতা ও অযৌক্তিক গোঁড়ামি৷ মানুষকে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রবর্তন করলেন সর্বান্যুসুত আধ্যাত্মিক দর্শন আনন্দমার্গের মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক৷ জলের ধর্ম যেমন ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া, ঠিক তেমনি মানুষের ধর্মও অনন্ত সুখপ্রাপ্তি৷ প্রতিটি মানুষ সুখ পেতে চায় আর এই সুখ যখন অনন্তের দিকে ধাবিত হয়, তখন তাকে বলে আনন্দ৷ সুতরাং আনন্দপ্রাপ্তিই মানুষের একমাত্র ধর্ম আর প্রকৃত আনন্দ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার পথেই অর্জন করা সম্ভব৷ আনন্দমার্গের মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমগ্র সৃষ্টিই পরমব্রহ্ম থেকে উৎসারিত একই ভাবে প্রতিটি মানুষ ও জীব, জড়, উদ্ভিদ সবই পরমব্রহ্ম পরমপুরুষের সন্তান৷ তাই সকল মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বেঁচে থাকার, আনন্দ পাওয়ার এগিয়ে চলার সমান অধিকার রয়েছে আর এই অধিকার পরমপুরুষ প্রদত্ত ৷ এই অধিকারকে খর্ব করার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি, বরং এই অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সকলকেই নিতে হবে৷ পৃথিবীতে কেউ একাকী বেঁচে থাকতে পারে না৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনধারণের জন্যে উপকরণের জন্যে প্রত্যেক জীব, জড়, উদ্ভিদ ও মানুষকে অপরের উপরে নির্ভর করতেই হয়৷ মানুষ জল-হাওয়া-খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না৷ তাই মানুষকে জড় পদার্থ জল হাওয়া ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ, শস্যরূপী উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর নির্ভর করতে হয়৷ একইভাবে অন্যান্য জীব, জড়, উদ্ভিদের প্রতি মানুষের কর্ত্তব্যও বর্তয়া এই কর্তব্যবোধই নব্যমানবতাবাদের উৎস ও প্রেরণা৷ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের জলবায়ু ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে মানুষের গাত্রবর্ণ, উচ্চতা, দৈহিক ঘটন বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়৷ মূলতঃ প্রত্যেক মানুষেরই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ধূলিকণাতে রয়েছে সমান অধিকার৷ পরমব্রহ্ম পরমপিতার সৃষ্টি সকল সত্তার মধ্যে এই যে সমতাভাব ও সম অধিকার--- এটিই হচ্ছে আনন্দমার্গ দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য৷ সেই কারণেই প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক, উৎসও এক৷ কেউ কোনোভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারে না৷ কোন অজুহাতেই কেউ কারোর ওপর কোনরকম শোষণ বা বঞ্চনাকে চাপিয়ে দেওয়ারও অধিকারী নয়৷
মানুষের অস্তিত্ব ত্রিভৌমিক---শারীরিক বা জাগতিক, মানসিক ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক৷ তাই মানবিক অস্তিত্বের সর্বাত্মক উন্নতির জন্যে জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক ত্রিবিধ উন্নতি একান্ত প্রয়োজন---কোনটিকেই অবহেলা করা চলবে না,নচেৎ জৈবিক সন্তুলন ও সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হতে বাধ্য মানুষের চাহিদা অনন্ত৷ এই অনন্ত চাহিদাকে সীমিত জাগতিক সম্পদে তৃপ্ত করা সম্ভব নয়৷ সেই কারণে জাগতিক সম্পদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রিত করে অসীম মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করতে পারলে অশান্ত মন শান্তির পথে অগ্রসর হবে৷ এই উদ্দেশ্যেই আনন্দমার্গ দর্শনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মনকে শান্ত ও নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা যুক্ত হয়েছে৷ অপরপক্ষে মানুষের জাগতিক ও ভৌতিক প্রয়োজনকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন অর্থনৈতিক সামাজিক দর্শন ‘প্রাউট’ (প্রাউট) বা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷ প্রাউট দর্শনের মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সম্পদের মালিক সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম ও সমগ্র সম্পদে সকলের ভোগদখলের সমান অধিকার রয়েছে৷ সৃষ্টিকর্তা কারোর নামে কোনো সম্পদের মালিকানা লিখে দেননি৷ সুতরাং এই সম্পদকে যথোচিত পদ্ধতি অবলম্বন করে সর্বাধিক উপযোগের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে! উপযুক্ত কারণ ও পরিস্থিতি ছাড়া কাউকে সঞ্চয় করার অধিকার দেওয়া যাবে না! সীমিত সম্পদ যদি কেউ অত্যধিক সঞ্চয় করে তবে অন্যদের বঞ্চনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই ভৌতিক সম্পদকে সুষমবন্টনের মাধ্যমে সকলের উপকারে লাগাতে হবে যাতে কেউ বঞ্চিত বা শোষিত না হয়৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments