নীলকন্ঠ দিবস--- শপথ নেওয়ার দিন

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, অতীতে যখনই কোন নূতন আবিষ্কার বা আদর্শ মানব সমাজের যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চেয়েছে তখনই সেই আদর্শের বিরোধিতায় যুথবদ্ধ হয়েছে সমস্ত অশুভশক্তি৷ পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে  আঁকড়ে ধরে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দীর্ঘায়িত করার চক্রান্তে সামিল হয়েছে তারা৷ নূতনের বার্র্তবহ, ধারক-বাহকের ওপর চলেছে অশেষ নির্যাতন,নিপীড়ন,প্রাণঘাতী অত্যাচার---এমনকি নেমে এসেছে অকাল মৃত্যুর নিষ্ঠুর আঘাত৷ গ্যালিলিও, সক্রেটিস,যীশুখ্রীষ্ট, হজরত মহম্মদ কিংবা মহাসম্ভূতি সদাশিব ও শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে৷ আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও৷ বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের  সমাজ জাত-পাত ধর্মমত, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ভেদে শতধা বিভক্ত৷  এই বিভাজনের ফলে মানুষে মানুষে সংঘাত, গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ সমাজের ভিতকে ক্রমশঃ দুর্বল করে চলেছে আর এর সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ শোষকের দল মানব সমাজের চরম সর্বনাশ করতে উদ্যত৷ কোথাও তথাকথিত ধর্মমতের চুড়ান্ত আগ্রাসন,কোথাও দাম্ভিক রাষ্ট্র-নায়কের সমগ্র পৃথিবীতে হিংসা ও সন্ত্রাসের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে৷ লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল নরনারী শিশুর দল সহায় সম্বলহীন হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বত, দুস্তর মরু অঞ্চল, প্রতি মূহূর্তের মৃত্যুর হাতছানি দেওয়া উত্তাল তরঙ্গমালাধৃত জলধির বুকে ভেলা ভাসিয়ে---শুধুমাত্র একটুকু নিরাপদ শান্তির আশ্রয়ের খোঁজে৷ একদিকে তথাকথিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধদের আস্ফালন, অন্যদিকে পুঁজিবাদী জড়বাদী আর্থিক-সামাজিক দর্শনের দুরভিসন্ধিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, সমস্যা জর্জরিত৷ পার্থিব সম্পদের অসম বন্টনে মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদের চূড়ায় বসে আমোদ-প্রমোদে মত্ত আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণা,রোগভোগের  তাড়নায় যন্ত্রনাক্লিষ্ট৷ এর সঙ্গে যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের  রণদামামা---পারমাণবিক, রাসায়নিক মারণাস্ত্রের বল্গাহীন প্রতিযোগিতা৷ আর একশ্রেণীর কপটাচারী দুর্নীতির ধবজাধারীরা শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে সদাব্যস্ত---তাদের ভাবখানা এই, যে যা করে করুক, আমরা আমাদের আখের গোছাই যাতে আমাদের সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতিরা দুধে ভাতে থাকে সারাজীবন৷ অথচ কোটি কোটি মানুষ অনাহার, অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর কবলে নিরুপায় হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কু-সংস্কার ও সর্বগ্রাসী ভয় তাদের নিত্যসঙ্গী৷ এই বিভিন্নমুখী সংঘাতের ফলশ্রুতিতে সমগ্র মানব সমাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ক্রমশ ধবংসেররসাতলে নিমজ্জমান!

এই যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হলেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি লক্ষ্য করলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো কুসংস্কার, ভাবজড়তা ও তথাকথিত ধর্মমত বা ইজমগুলির গোঁড়ামি---যার ফলে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, হানাহানি ও হিংসা-সন্ত্রাস৷ পৃথিবীতে যত ভয়ানক যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে তার বেশীরভাগেরই কারণ এই ধর্মান্ধতা ও অযৌক্তিক গোঁড়ামি৷ মানুষকে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রবর্তন করলেন সর্বান্যুসুত আধ্যাত্মিক দর্শন আনন্দমার্গের মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক৷ জলের ধর্ম যেমন ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া, ঠিক তেমনি মানুষের ধর্মও অনন্ত সুখপ্রাপ্তি৷ প্রতিটি মানুষ সুখ পেতে চায় আর এই সুখ যখন অনন্তের দিকে ধাবিত হয়, তখন তাকে বলে আনন্দ৷ সুতরাং আনন্দপ্রাপ্তিই মানুষের একমাত্র ধর্ম আর প্রকৃত আনন্দ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার পথেই অর্জন করা সম্ভব৷ আনন্দমার্গের মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমগ্র সৃষ্টিই পরমব্রহ্ম থেকে উৎসারিত একই ভাবে প্রতিটি মানুষ ও জীব, জড়, উদ্ভিদ সবই পরমব্রহ্ম পরমপুরুষের সন্তান৷ তাই সকল মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির  এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বেঁচে থাকার, আনন্দ পাওয়ার এগিয়ে চলার সমান অধিকার রয়েছে আর এই অধিকার পরমপুরুষ প্রদত্ত ৷ এই অধিকারকে খর্ব করার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি, বরং এই অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সকলকেই নিতে হবে৷ পৃথিবীতে কেউ একাকী বেঁচে থাকতে পারে না৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনধারণের জন্যে উপকরণের জন্যে প্রত্যেক জীব, জড়, উদ্ভিদ ও মানুষকে অপরের উপরে নির্ভর করতেই হয়৷ মানুষ  জল-হাওয়া-খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না৷ তাই মানুষকে জড় পদার্থ জল হাওয়া ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ, শস্যরূপী উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর নির্ভর করতে হয়৷ একইভাবে অন্যান্য জীব, জড়, উদ্ভিদের প্রতি মানুষের কর্ত্তব্যও বর্তয়া এই কর্তব্যবোধই নব্যমানবতাবাদের উৎস ও প্রেরণা৷ পৃথিবীর  বিভিন্ন স্থানের  জলবায়ু ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে মানুষের গাত্রবর্ণ, উচ্চতা, দৈহিক ঘটন বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়৷ মূলতঃ প্রত্যেক মানুষেরই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ধূলিকণাতে রয়েছে সমান অধিকার৷ পরমব্রহ্ম পরমপিতার সৃষ্টি সকল সত্তার মধ্যে এই যে সমতাভাব ও সম অধিকার--- এটিই হচ্ছে আনন্দমার্গ দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য৷ সেই কারণেই প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক,  উৎসও এক৷ কেউ কোনোভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারে না৷ কোন অজুহাতেই কেউ কারোর ওপর কোনরকম শোষণ বা বঞ্চনাকে  চাপিয়ে দেওয়ারও অধিকারী নয়৷

মানুষের অস্তিত্ব ত্রিভৌমিক---শারীরিক বা জাগতিক, মানসিক ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক৷ তাই মানবিক অস্তিত্বের সর্বাত্মক উন্নতির জন্যে জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক ত্রিবিধ উন্নতি একান্ত প্রয়োজন---কোনটিকেই  অবহেলা করা চলবে না,নচেৎ জৈবিক সন্তুলন ও সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হতে বাধ্য মানুষের চাহিদা অনন্ত৷ এই অনন্ত চাহিদাকে সীমিত জাগতিক সম্পদে তৃপ্ত করা সম্ভব নয়৷ সেই কারণে জাগতিক সম্পদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রিত করে অসীম মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করতে পারলে অশান্ত মন শান্তির পথে অগ্রসর হবে৷ এই উদ্দেশ্যেই আনন্দমার্গ দর্শনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মনকে শান্ত ও নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা যুক্ত হয়েছে৷ অপরপক্ষে মানুষের জাগতিক ও ভৌতিক প্রয়োজনকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন অর্থনৈতিক সামাজিক দর্শন ‘প্রাউট’ (প্রাউট) বা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷ প্রাউট দর্শনের মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সকল সম্পদের  মালিক সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম ও সমগ্র সম্পদে সকলের ভোগদখলের সমান অধিকার রয়েছে৷ সৃষ্টিকর্তা কারোর নামে কোনো সম্পদের মালিকানা লিখে দেননি৷ সুতরাং এই সম্পদকে যথোচিত পদ্ধতি অবলম্বন করে সর্বাধিক উপযোগের  মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার  করতে হবে! উপযুক্ত কারণ ও পরিস্থিতি ছাড়া কাউকে সঞ্চয় করার অধিকার দেওয়া যাবে না! সীমিত সম্পদ যদি কেউ অত্যধিক সঞ্চয় করে তবে অন্যদের বঞ্চনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই ভৌতিক  সম্পদকে সুষমবন্টনের মাধ্যমে সকলের উপকারে লাগাতে হবে যাতে কেউ বঞ্চিত বা  শোষিত না হয়৷ (ক্রমশঃ)