জগৎগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর একটি বাণীতে বলেছেন ---
‘‘ইতিহাসে দেখা গেছে যখনই মানুষ ধার্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোন ক্ষেত্রে স্পষ্ট কথা বলেছে, সন্দেহের নিরসন করেছে বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, তখনই তার বিরুদ্ধে পাপ শক্তি ষড়যন্ত্র করেছে, বিষ প্রয়োগ করেছে, অপপ্রচার করেছে, ক্ষেপে মরিয়া হয়ে উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে৷ নিষ্ঠুর ভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে, কিন্তু সেই আঘাতই আবার প্রত্যাহত হয়ে তারই কাছে ফিরে গেছে৷ নিজের আঘাতের প্রত্যাঘাতেই পাপশক্তি বিনষ্ট হয়েছে৷ তোমরা জেনে রেখো, ইতিহাসের অমোঘ বিধানে পাপ শক্তিকে বিধবস্ত হতেই হবে৷’’
বিশ্বের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে সর্বত্রই আমরা এই অমোঘ সত্যের প্রকাশ দেখতে পাব, তার নিজের জীবনেও তাই হয়েছে৷ আজকের সমাজে সর্বক্ষেত্রেই চলেছে দুর্নীতি, অন্যায় ও শোষণের পিশাচ নৃত্য৷ কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কি রাজনীতির ক্ষেত্রে, কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কি ধর্মের ক্ষেত্রে৷ সমস্ত ক্ষেত্রে আজ দুর্নীতি, শোষণ ও অন্যায়ের রাজ্যপাট চলেছে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই নয়, সমস্ত ক্ষেত্রে আজ যে দুর্নীতি ও শোষণ চলেছে, তার দৃঢ় প্রতিবাদ করেছেন ও সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রকার দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশনা দিয়েচেন৷
এই কারণে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কায়েমী স্বার্থবাদী তথা শোষকগোষ্ঠী মার্গগুরুদেব ও তার সংস্থার ওপর বার বার প্রবল আঘাত হেনেছে৷ বিশেষ করে তাঁর যুগান্তকারী ‘প্রাউট’ দর্শন ও তার প্রচারে এদেশের শোষক ও শাসকবর্গ ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল৷ তাই তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআইয়ের মাধ্যমে এক গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে ও তার জেরে ১৯৭১ সালে ২৯শে ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পটনা, বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক করে৷ শুধু তাই নয়, ১৯৭৫-এ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে তাঁর সংস্থাকে নিষিদ্ধ করে৷ তাঁর অনুগামীদের একে একে ‘মিশা’ আইনে কারাগারে নিক্ষেপ করে৷ আদালতে আবেদন করার পথ রুদ্ধ করে দেয়৷ এতে শাসকবর্গ নিশ্চিন্ত হতে পারে নি৷ এবার নির্জন কারান্তরালে মার্গগুরুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে৷ ১৯৭৩ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারী কারাগারের ভেতরেই ঔষধের নামেই তাঁর ওপর তীব্র বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ সঙ্গে সঙ্গে ওই তীব্র বিষের প্রতিক্রিয়াগুলি শরীরে ফুটে ওঠে৷ কিন্তু অধ্যাত্মিক শক্তিবলে তিনি ওই তীব্র বিষকে আত্মস্থ করে ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়৷ বিষ প্রয়োগের অব্যবহিত পরে এর বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্যে তিনি আবেদন করেন৷ সরকার তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য করে৷ তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী অমর প্রসাদ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে এক বেসরকারী তদন্ত কমিশন ঘটন করা হয়৷ ওই বেসরকারী তদন্ত কমিশন ওই ঘটনার বিশদ তদন্ত চালায়৷ ওই তদন্ত কমিশন রায় দেয় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর প্রকৃতই তীব্র বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ সরকার এই রায়কে আমল দেয়নি৷ ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে জেলের ভেতর বিষ প্রয়োগের গুরুতর অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করেন৷ তবু সরকার তাঁর দাবীর প্রতি কর্ণপাত করেননি৷ অবশেষে ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট পটনা হাইকোর্টের রায়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নির্দোষ প্রমাণিত হন ও তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান৷ এর আগে জরুরী অবস্থা উঠে যাবার পর তাঁর সংস্থার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহত হয়৷ কারামুক্তির পর তিনি তাঁর ঐতিহাসিক পাঁচ বছর চার মাস দু’দিনের অনশন ভঙ্গ করেন৷
কারাগারে পাপশক্তির দ্বারা প্রয়োগ করা তীব্র বিষ তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন বলে তাঁর বিশ্বজোড়া অনুগামীরা এই দিনটিকে ‘নীলকণ্ঠ দিবস’ হিসেবে পালন করেন৷
পৌরাণিক কাহিনীতে রয়েছে সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত নানান সম্পদ ও মনিমাণিক্য বিভিন্ন দেবতারা ভাগ করে নেন৷ তারপর সমুদ্র মন্থনে তীব্র বিষ উত্থিত হলে মহা চিন্তার মধ্যে পড়ে যান৷ কেননা এই তীব্র বিষে সমস্ত বিশ্ব ধবংস হবার উপক্রম দেখা দেয়৷ তখন দেবতাদের একান্ত অনুরোধে শিব এই বিষকে পান করে আত্মস্থ করেন৷ শিবের কণ্ঠ ওই তীব্র বিষে নীল রং প্রাপ্ত হয়৷ তখন থেকে শিবকে বলা হয় ‘নীলকণ্ঠ’৷ কবির ভাষায়---‘নীলকণ্ঠ করেছেন পৃথিবীরে নির্বিষ৷’ পুরাণের এই প্রতীকি কাহিনী অনুসরণেই ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারীকে নীলকণ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷ এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য অনেক গভীর৷ এদিন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ষড়যন্ত্রকারীদের হীন প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন৷ শুধু এইটুকুই নয়৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কারান্তরালে নিক্ষেপ করা ও নির্জন কারাভ্যন্তরে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের পেছনে যে আসল কারণ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে৷
সমাজের সর্বস্তরের যে অশুভ শক্তি দুর্নীতি শোষণ ও অন্যায়ের ভয়ঙ্কর জাল বিস্তার করে গোটা সমাজকে শোষণ করে চলেছে ও দুর্নীতির রাজ্যপাট বিস্তার করেছে, সর্বস্তরে এই দুর্নীতি ও শোষণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি সমস্ত প্রকার দুর্নীতি ও শোষণ থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্যে দিয়েছে তাঁর সর্বানুসূ্যত আনন্দমার্গ তথা ‘প্রাউট’ দর্শন৷ তাঁর এই যুগান্তকারী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর অনুগামী হয়েছেন ও এই সর্বব্যাপী পাপশক্তিকে ধবংস করার জন্যে বিশ্বব্যাপী সংঘটন স্থাপন করেছেন৷
সেদিন শোষক শক্তি এই কারণেই তাঁকে ও তাঁর সংস্থাকে ধবংস করতে এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল৷ তাই তারা তাঁর সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁর ওপর বিষ প্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল৷
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ঐশী শক্তিবলে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সংস্থা আজ বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশে ’ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামী এক সর্বস্তরের শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়তে বিশ্বজুড়ে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে৷
‘‘নীলকণ্ঠ দিবস’ সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শুভ ও অশুভের সংগ্রামে শুভের জয় হবেই৷ ১৯৭৩ সালে বিষপ্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করার পরের আনন্দপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে তিনি যে বাণীটি দিয়েছিলেন সেই বাণীটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ৷ এটিকে এই নীলকণ্ঠ দিবসের তাৎপর্যও বলতে পারি৷ এই বাণীটি হ’ল---
‘‘অন্ধকার যতই ঘন হোক না কেন তারপর প্রভাত আসবেই আসবে৷ অন্ধকারের পিশাচ যতই অট্টহাসি হাসুক না কেন সূর্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তার সবকিছুই শূন্যে মিলিয়ে যাবেই যাবে৷ তেমনই মানুষ জাতির দুঃখের রাত্রী যেরকমই হোক না কেন তপস্যার সূর্যালোক তাঁর সমস্ত অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেবেই দেবে৷ মানুষের জীবনে অরুণোদয় হবেই হবে৷
- Log in to post comments