নীলকন্ঠ করেছেন পৃথিবীরে নির্বিষ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

‘আজ অর্থনীতি বস্তাপচা তত্ত্ব কথার কচকচানি ছাড়া আর কিছুই নয়৷ একে অধিকতর বাস্তবমুখী করতে হবে ৷’--- অর্থনীতি হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রয়োগ ভৌমিক বিজ্ঞান, আর একে সর্বজীবের তথা সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে বিকশিত করতে হবে৷

অর্থনীতি বিষয়ে এমন কথা যিনি বলতে পারেন--- পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক (?) রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসক ও পুঁজিবাদী শোষকের আতঙ্কের কারণ হবেন তিনি এটাই স্বাভাবিক৷ আর অর্থনীতিতে তিনি শুধু তত্ত্ব কথাই শুনিয়ে যাননি৷ বিশ্ব মানবের আর্থিক মুক্তির জন্যে, সর্বজীবের সার্বিক কল্যাণের জন্যে৷ তিনি দিয়েছেন পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত বাজারে অর্থনীতির বিকল্প বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা--- স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ অঞ্চলগুলি গড়ে তুলতে তিনি দিলেন কৃষি-শিল্পের সমন্বয়ে ব্লকভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা৷ জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা পূর্ত্তি ও বিশেষ গুণ সম্পদের জন্যে বিশেষ সুখ সুবিধা৷ এযে একেবারে শোষণের মূল উৎপাটনের ব্যবস্থা! চমকে উঠলো পুঁজিবাদী শোষক ও স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ৷

শুধু তাই নয়, মানব ধর্মকে সব রকম কুসংস্কার, ভাবজড়তা ও অন্ধবিশ্বাসের আবর্জনা মুক্ত করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বিদ্বেষকে দুরে সরিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠার পথে চালিত করলেন৷ আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে বলেন---‘‘আধ্যাত্মিকতা কোন ভিত্তিহীন কল্পনা বিলাস নয়৷ আধ্যাত্মিকতাকে আমরা আমাদের কঠোর বাস্তব দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন ও উপলদ্ধি করতে পারি৷ এই আধ্যাত্মিক হ’ল মানবমনের বিবর্ত্তন তথা সর্বচ্চ স্তরে উত্তরণের নামান্তর, এর সঙ্গে কুসংস্কার ও নৈরাশ্যবাদের কোন সম্পর্ক নেই৷ আধ্যাত্মিকতা মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভেদকে স্বীকার তো করেই না, বরং আধ্যাত্মিকতা বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা চায়৷ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনেও অসংস্কৃতি ও অশ্লীলতার স্রোত বন্ধ করে সেবা ও কল্যাণের পথে চালিত করলেন৷

বিভেদ-বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িক হানাহানি যাদের কাছে রাজনীতির মূলধন, শোষণের হাতিয়ার এবার সত্যিই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তারা৷ এ কোন দর্শন নিয়ে এলেন, কোন মহাপুরুষ৷ একে বাঁচিয়ে রাখলে শোষণ ও দুর্নীতির রাজ্যে পাট ছেড়ে বনবাসে যেতে হবে৷

অতএব শুরু হ’ল ষড়যন্ত্র৷ মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে বন্দী করে রাখা হ’ল বিহারের পটনা বাকীপুর সেন্ট্রাল জেলে৷ দিনটা ছিল, ২৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১৷ কিন্তু এমন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাইতো বিপদ৷ তাই ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী নির্জন কারান্তরালে ঔষধের নামে খেতে দেওয়া হ’ল তীব্র বিষ৷ খেলেন তিনি সেই বিষ৷ এবার নিশ্চিন্ত স্বৈরাচারী শাসকবর্গ, ফ্যাসিষ্ট শোষক শ্রেণী৷

কিন্তু হায়! ‘‘অচিন্ত্য এ ব্রহ্মাণ্ডের লোক-লোকান্তরে অনন্ত শাসন যাঁর চিরকালতরে প্রত্যেক অনুর মাঝে হতেছে প্রকাশ সেই তিনিই ধরাধামে এসেছেন শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নাম রূপের মাধ্যমে সমাজকে সর্বপ্রকার পাপ, অনাচার শোষণ থেকে মুক্ত করে নোতুন বিশ্ব গড়ার সংকল্প নিয়ে তাঁকে হত্যা করবে কোন মূঢ়-জন! তাই তীব্র বিষের কিছু প্রতিক্রিয়া শরীরে দেখা দিলেও ষড়যন্ত্রকারীদের অপপ্রয়াস ব্যর্থ করে হজম করে নিলেন সেই বিষ৷ পুরানে কথিত আছে সমুদ্র মন্থন করে উত্থিত বিষ পান করে সমাজকে রক্ষা করেছিলেন সদাশিব৷ সেই বিষের প্রতিক্রিয়ায় শিবের কন্ঠ নীল হয়ে গিয়েছিল৷ তাই শিবের আর এক নাম নীলকন্ঠ ‘‘নীলকন্ঠ করেছেন পৃথিবীরে নির্বিষ’৷ বর্তমান সমাজেও স্বৈরাচারী শাসক ও ফ্যাসিষ্ট শোষকের হীন চক্রান্তে রাজনীতির নামে চলছে হিংসার উৎসব, স্বার্থের সংঘাত৷ সভ্যতা বিমুখ, নির্দয় শোষক বিষদন্তের ছোবলে ছোবলে সমাজকে করে তুলেছে জর্জরিত৷ সেই বিষদন্তের মূলে আঘাত করেছে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর সর্বানুসূ্যত জীবন দর্শন--- আনন্দমার্গ৷ আজ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই জীবন দর্শনের অনুগামী৷ ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত ব্যর্থ৷ নীলকন্ঠ দিবস এটাই প্রমাণ করে শুভ-অশুভ শক্তির সংগ্রামে অশুভ শক্তি কোনদিনই জয়ী হতে পারে না৷ শাসক ও শোষকের সব ষড়যন্ত্রের বিষ হজম করে সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে পাঁচবছরের ও বেশী সময় অনশন করে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে কারান্তরাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ জগৎকে যিনি নির্বিষ করতে এসেছেন তাঁকে হত্যা করবে কোন মূঢ়জন! তিনি যে নীলকন্ঠ৷ পৃথিবীকে নির্বিষ করতেই তাঁর আগমন৷