সোনার বাংলা! সে কি আর আদৌ আছে! না সেই বই---কবিতা, পদ্য, গদ্যের মধ্যেই সোনার বাংলার সীমাবদ্ধতা৷ সোনার বাংলায় শাসক আসে আর যায়৷ বাংলা মায়ের মলিন মুখ সেই তেমনি থাকে৷ জনগণের সার্বিকভাবে উন্নতি আর হয় না৷ রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের বিদ্রোহী বাংলা আজ বেকারত্বের জ্বালায় পুড়ে ছারখার৷ কোথায় সেই সোনার বাংলা! কোথায় সেই সারা ভারতকে পথ দেখানো সেই বাংলা? রাজনীতি করে বোটে জিতে বাংলার গদিতে দীর্ঘকাল থাকা যায় কিন্তু সে মতন উন্নয়ন করে না কেউ৷ এপার বাংলায় কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট, আর বর্তমানে তূণমূলের বাংলা সকলে মিলে আজ ৭০ বছর চলে গেছে৷ ওপারে শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়ার বাংলা সেই একই চিত্র৷ বাঙালী ছেলেরা মেয়েরা বহির্বঙ্গে একটা কাজের জন্য ছুটে যাচ্ছে, শুধু একটু আয় করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ভিন দেশে৷ কিন্তু এটা কি কিছু গৌরবের কথা৷ না এটা হতে পারে না৷ একে বলে বাগালী করা৷ বাংলার বাইরে আজ দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, পুনে, কেরল, ব্যাঙ্গালোরে যত বাঙালী ছেলে-মেয়েরা কাজ করে তাদের মধ্যে ১০-২০ শতাংশ ছেড়ে দিলে বাকিরা সব লেবার শ্রমিক, ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারী, এটিএম গার্ড, অফিসবয় ও অফিসের গার্ড হতে বা হোটেল-রেস্তোরাঁতে খাটতে যায়৷ আর কিছু যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে, অন্য দিকে মেডিক্যালের জন্য লক্ষ লক্ষ বাঙালী যে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর, ব্যঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই যায় এই ভয়াবহ চিত্র তো না বলাই ভালো৷ লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে দক্ষিণে ছোটে চিকিৎসার জন্য ৷ আর হ্যাঁ যে কর্পোরেটের টাকা বাহির রাজ্য থেকে আসে এ রাজ্যে তা আবার ফিরে যায় চিকিৎসা খরচ হিসেবে৷ হ্যাঁ যারা যায়, তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই যায়৷ রাজ্যে চিটফান্ড, রাজনৈতিক লুট ও তোলাবাজী, ডাক্তার-হাসপাতালের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া, বেকার সমস্যার মহামারী, রাজনৈতিক নেতাদের পাইয়ে দেওয়া সিস্টেম, তথা সরকারি-বেসরকারী কলকারখানা ও কোম্পানীর আকালের জন্য তারা যেতে বাধ্য হয়৷ অন্য রাজ্যে ছোটখাটো কাজে চাকর নোকর হিসেবে কাজকর্ম করাতে মোটেই বাংলার গৌরব বৃদ্ধি হয় না৷ যতদিন না বাংলার মধ্যে সামাজিক আর্থিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ হচ্ছে, ততদিন এই ট্রেডিশন সমানে চলবে৷
আরও দেখেছি বাংলার ছেলে মেয়েরা সাধারণ শিক্ষার জন্য কানপুর, রাঁচী, ডালটনগঞ্জ, সম্বলপুর, ভুবনেশ্বর, বিলাসপুর, বেনারস, কোটাতে পড়তে যায়৷ সেখানে তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ডিগ্রিধারী হয়ে বাংলায় ফিরে আসে৷ এভাবে বাংলার অর্থের বহিঃস্রোত হয়ে চলছে৷
আর অন্যদিকে ওপার বাংলার কথা বলছেন৷ তারা তো দুবাই, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়াতে যায়৷ সেখানে তারাও যায় বাধ্য হয়েই৷ দেশে কর্মসংস্থান নেই৷ কয়েকলক্ষ বাংলাদেশী নারী পুরুষ আজ মধ্য প্রাচ্যে৷ কেউ লেবার শ্রমিক , অফিস বয়, ড্রাইভার, মেকানিক কাজে৷ মেয়েরা যায় পারিবারিক হেল্পার, ঝি হিসাবে৷ তাদের কাছে আজ বাংলাদেশ হয়েছে ‘‘লেবার কান্ট্রি’’৷ যারা বিদেশে যেতে পারে না তারা কাঁটাতার পেরোয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ তাদের মধ্যে কেউ ধরা পড়ে কেউবা জেল খেটে আবার দেশে ফেরে৷
দুই বছর আগে সৌদিতে থাকাকালীন কথা হয়েছিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শফিকুল ইসলামের সাথে৷ সেখানে আমার অফিসেই কাজ করত৷ জিজ্ঞাসা করতে জানালো সেখানে তারা একটি লেবার কলোনিতে থাকে৷ তার কাজ বলতে অফিস টেবিল চেয়ার মোছার কাজ৷ এমনি অনেকে তাদের সাথে থাকে৷ কেউ গাড়ি মোছে, কেউ ঝাঁটা মারে, কেউ গাছে জল দেয়৷ তার সাথে অনেক কিছুই কথা হল দেশের বাড়ি নিয়ে৷ কিন্তু সে সকল শুণে মনটা খুব খারাপ লেগে গেল৷ ভাবলাম বাংলা থেকে এই কয়েক হাজার টাকার জন্য নিজের দেশ মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে আজ সৌদিতে৷
হ্যাঁ শফিকুলরা ভিন দেশে যায়, যেমন যায় পশ্চিমবাংলার মানুষ ভারতে ভিন রাজ্যে৷ দুই বাংলার চিত্র একই৷ এই হল আজকের সোনার বাংলা৷ রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা ! নজরুলের বিদ্রোহী বাংলা ! জীবনানন্দের রূপসী বাংলা !
ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে গিয়ে মানুষ যে কেমন আনন্দে বা শান্তিতে থাকে তা যারা থাকে তারা ভালো জানে৷ আমারও তার অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ বাংলার মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ যত দিন চলবে তত দিন এই চিত্রই দেখে যেতে হবে৷ পশ্চিমবাংলার কলকারখানা, চাবাগান, কয়লা খনি , বড় বাজার সবই অবাঙালীর হাতে তুলে দিয়ে বাঙালী ছোটে ভিন রাজ্যে৷ শুধু ভারতের ব্যাঙ্গালোরে আজ ৫ লক্ষের উপরে বাঙালী৷ সৌদিতে তা ২০লক্ষের উপরে৷ অন্যান্য শহর ও দেশের হিসেব বাদই থাকুক৷
বাংলাদেশ মধ্য প্রাচ্য তথা সৌদি আরবের জন্য ‘‘লেবার কান্ট্রি’’ হয়েছে৷ তেমনটি আজ ভারতে পশ্চিমবঙ্গ হতে চলেছে৷ এই নামেই সৌদি রাজ বাংলাদেশে অর্থ দেয় শিক্ষা, চিকিৎসা, দেশ গড়ার জন্য নয়৷ তারা প্রচুর অর্থ দেয় শিক্ষা, চিকিৎসা, দেশ গড়ার জন্য নয়৷ তারা প্রচুর অর্থ দেয় মসজিদ গড়তে, মোল্লা তৈরি করতে যাতে ধর্মের সূত্র দিয়ে দুই দেশের সংযোগ গড়ে উঠে৷ তার ফলে বাংলাদেশীরা আরও বেশী করে লেবার শ্রমিক হিসেবে, গৃহকাজে, বাগান পরিষ্কারের কাজে যেতে পারে৷ সৌদি চাইছে দেশে বেশি করে মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠুক আর মানুষ জীবনের কষ্ট করে জমানো লক্ষ লক্ষ অর্থ, টাকা কড়ি নিয়ে খরচ করে হজে যাক বেশিবেশি করে৷ আরও সৌদি মুখী হোক৷ কিন্তু সৌদি তথা আরব দেশগুলো যদি শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা তথা দেশের উন্নয়নে অর্থ অনুদান দিত তাহলে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার প্রফেসর, বৈজ্ঞানিক হয়ে অন্য দেশে দেশে পাড়ি জমাতে পাড়ত৷ বাংলাদেশীদের লেবার শ্রমিক হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে হত না৷ কিন্তু সৌদি তথা আরব দেশগুলো কি সেটা চাইবে! মোটেই না৷ সেটা চাইলে তো তাহলে তাদের লেবার শ্রমিকের, ঝি চাকরের কাজ করে দেবে কে? আজ বেকারদের ধরতে সরকারী তথা বেসরকারী সাহায্য প্রাপ্ত বিভিন্ন এজেন্সিগুলো তাই ছুটে আসে এই বাংলায় এপারে ওপারে৷ যেদিন শারজাহ বিমান বন্দরে রেষ্টরুমে উঠি, দেখছি শতশত বাংলাদেশী নারী বিমানের অপেক্ষায়৷ তাদের পরিধান, ঠাটবাট দেখে বুঝলাম দেশে কত করুণ অবস্থা না হলে এইভাবে কেউ পরদেশে যায় না ঝি চাকরের কাজ করতে৷ এদের উপর কত নির্র্যতন, শোষণ হয় তবুও সৌদি দুবাই আরবে যেতে হয়৷ আজ এই অন্যদিকে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে অহরহ বিপুলহারে বাংলাদেশীরা ভারতে আসে কম টাকার চিকিৎসা পাবার জন্য৷ ভিড় করে কলকাতা, তথা দক্ষিণ ভারতের ভেলোর, চেন্নাই বাঙ্গালোরের হাসপাতালগুলিতে৷ শুধু বাংলাদেশী নয় পশ্চিমবাঙলার বাঙালীদেরও একই কথা সেই দক্ষিণে ৷ তাদের আশা যাতে কম খরচে ভালো চিকিৎসা পাওয়া একটু সুস্থ হওয়া৷ কি দুবাই কি শারজাহ বিমান বন্দর , কি হাওড়া, শিয়ালদহ, কি ঢাকা রেলস্টেশন-দেখছি কত কত হাজার হাজার বাঙালীর কাজে যাওয়ার ভিড়৷ চিত্র ওই একই ৷ ইহাই কি মোদের সোনার বাংলা৷ যখন হায়দ্রাবাদ ও ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম তখন দেখতাম উদ্বাস্তু বাঙালীদের বাঙালী বস্তি গড়ে উঠেছে৷ শত বাঙালী ক্লাবের দুর্র্গেৎসবের অনুষ্ঠান৷ কিন্তু বাংলার বাইরেও কি বাঙালী ভালো আছে৷ বলি, না৷ বাঙালী আজ মার খাচ্ছে নয়ডা, দিল্লী, রাজস্তান, সৌদি, দুবাইয়ে৷ বাঙালী আজ মার খাচ্ছে বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চল অসম, নাগাল্যান্ডে, নিজভূমি দার্জিলিং-মায়ানমারে৷ অসমের বরাক, কাছাড়, শিলচর ধূবড়ি, নওগাঁও বাঙালী নিজভূমে আজ বহিরাগত৷ বাংলার ভূমির ডানা ছাঁটা গেছে ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যাতে৷ দার্জিলিং আজ হাত ছাড়ার মুখে৷ বাঙালী মার খাচ্ছে দিকে দিকে৷
ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে লেবার শ্রমিক হয়ে পারিবারিক সাহায্যে কাজে যাওয়া কোন মান, গৌরবের কথা নয়৷ এটা বাংলা মায়ের অগৌরব গাথা৷ কিন্তু কে বোঝে আর! সকলে লুটের মাল ঝুলিতে, পকেটে ভরতে ব্যস্ত৷ আরব দুনিয়া নিজের ভালোটা বোঝে , ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অর্থদান করে৷ বলা যায় পাগলেও নিজের কথা ভাবে কিন্তু বাঙালী নিজের কথা ভাবে না৷ তারা ভাবে অন্যের ঘরে কাজ করে আজ ভালোই আছে৷ বর্তমানে কেউ ধর্মের নামে, কেউ স্থানীয় সংসৃকতি বা ভাষাকে অবদমিত করে বাংলাকে আর্থিক ও সামাজিক ভাবে শোষণ করছে৷ কিন্তু বাংলার সার্বিক উন্নতি তথা উন্নয়নে কোন রাজনৈতিক সামাজিক সংঘটনের বিশেষ চিন্তা নেই৷ শত বর্ষ আগে মহামতি গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘what Bengal thinks today India thinks tomorrow’’ কি অতীত হয়েই থেকে যাবে?
বাংলা ও বাঙালীর উন্নতির একটাই পথ সেটা হল আর্থ সামাজিক উন্নয়ন৷ সামাজিক অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাকে উঠে দাঁড়ানো৷ চাই ব্লকভিত্তিক আর্থিক পরিকল্পনা৷ আর এই সম্ভব হবে একমাত্র প্রাউটের রূপরেখা দিয়েই৷ শোষণ করবো না শোষিত রবো না৷ নিজের পায়ে বাংলাকে দাঁড়িয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা আজ বাঙালীদের নিজেদেরই কর্তব্য৷ এবার আর বাংলা ভাগ নয়, বরং ভাঙা বাংলাকে জোড়া লাগাও৷
কবির ভাষায় ঃ ---
বাংলার মাটি , বাংলার জল
বাংলার বায়ু , বাংলার ফল
পূণ্য হোক হউক , পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান৷৷
বাংলার ঘর , বাংলার হাট,
বাংলার বন , বাংলার মাঠ---
পূণ্য হোক হউক , পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান৷৷
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা
সত্য হউক , সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান৷৷
বাঙালির প্রাণ , বাঙালির মন
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক , এক হউক
এক হউক হে ভগবান৷৷
বাঙালি জাতি যেদিন এক হবে সেদিনই আবার দুনিয়াকে পথ দেখিয়ে বলতে পারবে বাংলার মানুষ-‘what bengal thinks today India thinks tomorrow’’ সেই দিনের আশায় বসে
- Log in to post comments