প্রাউটিষ্ট ফোরাম

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বাঙলা একদিন উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছিল সেই বাঙলাতে আজ সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংকট চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে৷ বাঙলার যুব সমাজের সামনে খোলা আছে দারিদ্র, বেকারী, অনাহার ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতা৷ একদিকে রক্তপিশাচ পুঁজিপতির দল রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে হাতিয়ার করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে দিন দিন স্ফীতকায় হয়ে উঠছে দুর্নীতি, কালোবাজারী ও মজুতদারিতে ছেয়ে গেছে জীবনের সর্বস্তর–অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা নোংরা দলীয় রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত্তে পতিত স্বার্থলোলুপতা, আদর্শভ্রষ্টতা ও ব্যভিচারে আজ বাঙলার নেতৃত্ব শক্তি কলুষিত ও বিপথগামী৷ বাঙলার জনগণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা৷ আমরা ভুলেই গেছি বরেণ্য বাঙালী মনীষী, কবি, সাধক, রাজনীতিক ও বিপ্লবী যোদ্ধাগণের অবদানের ইতিহাস, ভুলে গেছি অতীতের সুসমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে৷ বাঙলা আজ অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের কবলে নিদারুণ অসহায় ও বিপন্ন৷

বাঙলার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার জন্যে চলছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র৷ তাই ঝাড়খণ্ড, ওড়িষ্যা, অসম আন্দামান প্রভৃতি অঞ্চলের বাঙালীরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷ একইভাবে উর্দু প্রেমিকেরা চেয়েছিল পূর্ববাঙলার মানুষকে তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার পথ থেকে বিচ্যুত করতে৷ এরা চক্রান্ত করেছিল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে দিতে৷ কিন্তু পূর্ব বাংলার বৈপ্লবিক চেতনা–সম্পন্ন মানুষ এই অন্যায় সহ্য করেননি৷ তাজা রক্তের বিনিময়ে তাঁরা মাতৃভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন ওই জঘন্য ষড়যন্ত্রকে৷ বৃহত্তর বাঙলার সম্ভাবনায় ওরা শঙ্কিত, কারণ বাঙলার সংহত শক্তি ওদের কাছে মৃত্যুবান তুল্য৷ তাই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিপতির দল এখনো চেষ্টা করছে বাঙালীজাতির স্বতঃস্ফূর্ত ভাবপ্রকাশের অভিব্যক্তি মাতৃস্বরূপা বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিয়ে তার মহিমামণ্ডিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে৷ বাঙালীকে সর্বপ্রকার শোষণের শিকারে পরিণত করে এর সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন করতে ও দাবিয়ে রাখতে এরা সদা জাগ্রত৷

আমরা কি এই তীব্র সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুত হতে পারি না আমরা কি পারি না, এই ষড়যন্ত্রের ব্যুহজাল ছিন্ন–ভিন্ন করে বাঙালীর জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এক নোতুন বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে, সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রামে বাঙলার প্রাণশক্তিকে জাগ্রত করে এক প্রগতিশীল বঙ্গভূমির প্রতিষ্ঠা করতে৷ আমরা নিশ্চয়ই পারি যদি হতাশার মানসিকতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আশাবাদী মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে গড়ে তুলি সৃজনশীল মানসিকতার দুর্গ৷

আজ আমাদের এমন এক কর্মপ্রেরণা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যার ফলে প্রতিটি বাঙালীর জীবনে মূল্যবোধ ফিরে আসবে, বাংলার প্রতিটি মানুষের জীবনে ফিরে আসবে সুখ, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও সর্বাত্মক বিকাশের উন্মুক্ত রাজপথ৷ রামমোহন, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রতাপাদিত্য, চাঁদরায়, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকী, তিতুমীর, সূর্য্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল, দীনেশ পৌরুষের বজ্রকৌস্তুভ স্বাধীনতার জাগ্রত প্রহরী নেতাজী সুভাষচন্দ্রের যে দুর্লভ ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে আমরা যদি সেই ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে চলতে পারি তাহলে আজকের বাঙলার বুকে যে পাপশক্তি বাঙলাকে ভাগ করে বাঙলার সম্পদ লুন্ঠন করে গুজরাটকে সমৃদ্ধ করতে চাইছে তার অবসান হতে বাধ্য৷

অতএব পবিত্রভূমি বাঙালীর সর্বাত্মক মুক্তি ও সামাজিক প্রগতির জন্যে ও কোটি কোটি বাঙালীকে নিয়ে নোতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে আমরা কি মরণপন সংগামে উদ্বুদ্ধ হতে পারি না আজকের প্রজন্ম ভ্রান্ত পথে পরিচালিত৷ পাশ্চাত্ত্যের ভাষা–সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার অনুকরণে চলতে তাঁরা অভ্যস্ত৷ প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালীরা বাঙালীর ঐতিহ্যমণ্ডিত ভাষা–সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্ত্যের গড্ডালিকা প্রবাহে নিমজ্জিত – বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আক্ষেপের সুরে স্মরণীয় উক্তি যা আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রাণে যোগায় নোতুন প্রাণের সঞ্চার–

‘‘সাতকোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী–

রেখেছ বাঙালী করে – মানুষ করনি৷’’

মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, নাগাল্যাণ্ড, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল প্রভৃতি রাজ্যগুলি তৈরী করা হয়েছে কিন্তু বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমির সীমানা পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত বাঙলার দাবী বিগত ২০০ বছরের উর্ধ্বে এ যাবৎ উপেক্ষিত রয়ে গেছে৷

বৃহৎ ভূখণ্ডে বসবাসকারী কোটি কোটি বাঙালী দেহে, মনে ও প্রাণে বইছে এক রক্তস্রোত৷ এখন শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে চলুক এক ভাবতরঙ্গ, এক কর্মযজ্ঞের ডাক, আসমুদ্র হিমাচল এক উত্তালতরঙ্গ পাহাড়ে, বনে, জঙ্গলে, মাঠে, ময়দানে, কারখানায়, বিদ্যায়তনে বাঙালীর জীবনপথে সঞ্চার করুক এক নোতুন প্রাণ প্রবাহের৷ আজ কোটি কোটি বাঙালীর মুক্তি পথযাত্রায় পবিত্র ‘বাঙালীস্তান’–এর দাবীতে আমাদের দুর্জয় সাহস ও নিরলস প্রচেষ্টায় সফল ও সার্থক করে তুলতে হবে৷ বাঙলার সকল যুক্তিবাদী সমর্থিত বুদ্ধিমান মানুষকে এ সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত হয়ে এক সুচিন্তিত এক বলিষ্ঠ কর্মসূচী গ্রহণ করতেই হবে৷

‘‘বাঙালী অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না, সাংঘাতিক মার খেয়েও মারের উপর মাথা তুলবে’’ –রবীন্দ্রনাথ

তাই আসুন বাঙলার সব ভাই ও বোনেরা রাজনৈতিক দলাদলি বন্ধ করে শুরু করি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন৷ বহুযুগের মনীষা, প্রতিভা ও বীরত্বের প্রতীক স্বরূপ বহু সভ্যতার অবদানে গড়া এই বাংলা আবার জাগছে–তার এই জাগরণ জগতের কোন শক্তিই রোধ করতে পারবে না–বাঙলা মা ঘুমিয়ে থাকবে না–বাঙলার এই নবজাগরণে মানব ইতিহাস নোতুন পথের সন্ধান পাবে৷ নোতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পত্তনের জন্যে সেবা ও ত্যাগের ভিত্তিতে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, একদিকে বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থবাদী পাপচক্রের বিরুদ্ধে আমাদের সীমাহীন সংগ্রামে বদ্ধপরিকর হতে হবে অন্যদিকে আমাদের সংগ্রামী শক্তিকে বৃহত্তর বাঙালীস্তানের স্বপ্ণকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে সুসংহত করতে হবে, এর যথোপযুক্ত প্রয়োগ করতে হবে৷ এই বিরাট বাঙালীস্তানের সমস্ত নরনারীকে সর্বপ্রকার মিলিত প্রয়াস, ত্যাগ ও স্বপ্ণ দিয়ে এই অসাধারণ ঐতিহাসিক কর্ম সম্পন্ন করার ব্রতই আজ প্রতিটি বাঙালীকে গ্রহণ করতে হবে৷

আজ বাঙলার বুকে যে দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, শোষণ ও নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা পরিদৃষ্ট হচ্ছে তার মূলোচ্ছেদ করতে হলে সম্পূর্ণ বাঙালী জাতির মুক্তি আন্দোলনে আমাদের একসাথে গর্জে উঠতে হবে–এক লক্ষ্যের পানে চলার পথে বাঙলার বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্র, যুবক, কর্ষক–মজদুর সকলকে একত্রিত হতে হবে৷ শতধা–বিচ্ছিন্ন বাঙালী সমাজকে একতা, বিশ্বাস, আত্মত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন বিরামহীন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে হবে৷

লাঞ্ছিত বাঙলার ধূলিলুণ্ঠিত আত্মা আজ তাকিয়ে আছে পূব আকশের দিকে–নোতুন নেতৃত্ব শক্তির নোতুন পথের নির্ভুল ইঙ্গিতের আশায়৷ তাদের সামনে থেকে অমানিশার অন্ধতমিস্রা মুছে যাক৷ বিরাট বাঙালীস্তানের সার্থক রূপায়নে তাদের সামনে খুলে যাক আশা ও সমৃদ্ধির নবদিগন্ত–নোতুন সূর্য্যোদয়ে নোতুন দিনের বাঙালী নোতুন পৃথিবীতে জেগে উঠুক সর্বপ্রকার বন্ধনকে জয় করে৷ (প্রাক্তন সমাজ সচিব শঙ্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনা থেকে সংগৃহীত)