প্রভাত সঙ্গীত---আলোয় উত্তরণের সঙ্গীত

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

শুভ ‘প্রভাত সঙ্গীত দিবসে’র আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন৷ এবছর প্রভাত সঙ্গীতে’র ৪২ তম বর্ষপূর্তি৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তথা ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তী রচিত ও সুরারোপিত ১৯৮২ সন থেকে ১৯৯০ সন পর্যন্ত ৮ বছর সময়কালে ৮টি ভাষায় ৫০১৮টি সঙ্গীত ‘প্রভাত সঙ্গীত’ নামে পরিচিত৷

প্রভাতসঙ্গীত স্রষ্টা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রতি হৃদয়ের গভীরতম শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি৷

দার্শনিক শ্রীপি.আর সরকার প্রবর্তিত ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ নামে সামাজিক- অর্থনৈতিক -রাজনৈতিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন৷ প্রাউটের আগমন সেই সময় বিশ্বজুড়ে যখন চলছে ধনতন্ত্র ও মার্কসবাদের ঠাণ্ডা লড়াই৷ তিনিই আবার অপর দিকে পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তী রূপে ‘আনন্দমার্গ প্রচারক সঙ্ঘে’র প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘটন পরিচালনা, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ভাবনার নূতন চালিকাশক্তি ‘নব্যমানবতাবাদে’র উদ্ভাবন করেছিলেন৷ এছাড়াও তিনি আধ্যাত্মিক দর্শন, যোগসাধনা, সমাজবিজ্ঞান, শিক্ষা, কৃষি, নন্দনবিজ্ঞান,মোহনবিজ্ঞান,ইতিহাস, ভূবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব, ধবনিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, যৌগিক চিকিৎসা, নারীমুক্তি, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানজগতের অসংখ্য বিষয়ের ওপর তিনি ভাবগম্ভীর আলোকপাত করেছেন৷ এরই অবকাশে ১৯৮২ সালের ১৪সেপ্ঢেম্বর বিস্ময়করভাবে তিনি একজন সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন৷ ঐদিন পশ্চিম রাঢ়ের দেওঘরের (তৎকালীন বিহার রাজ্য ও বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) আশ্রমিক পরিবেশে ‘বন্ধু হে নিয়ে চলো’ প্রভাত সঙ্গীতটি প্রথম তিনি রচনা করেন৷ এই ১৪ সেপ্ঢেম্বর-ই ‘‘প্রভাত সঙ্গীত দিবস’’ হিসেবে পালিত হয়৷ ১৯৯০ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি মোট ৫০১৮টি সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন৷ এই বিশাল সঙ্গীতসম্ভারই বর্তমান বিশ্বে ‘প্রভাত সঙ্গীত’ নামে জনপ্রিয় ও সুপরিচিত৷ বাংলা,সংস্কৃত,ইংরেজী, হিন্দী, ঊর্দু, অঙ্গিকা, মগহী ও মৈথিলী এই ৮টি ভাষায় শ্রীসরকার সঙ্গীত রচনা করেছেন৷

‘প্রভাতসঙ্গীত’ প্রভাতকালিক সঙ্গীত নয়, অথবা রচয়িতার নামের অনুসরণেই এর এহেন নামকরণ এটাও সর্বাংশে সত্য নয়৷ বর্তমান সাংস্কৃতিক জগতের পঙ্কিল ও ক্লেদাক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাতসঙ্গীত এক সার্বিক রেণেশাঁ বা নবজাগরণ, যা বর্তমান পৃথিবীর হতাশাগ্রস্থ মানবতার কাছে নতুন আশা, স্বপ্ণ, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল প্রভাতের স্বর্ণালোক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে৷ প্রভাতসঙ্গীত অন্ধকার থেকে উত্তরণ সঙ্গীত৷ এখানেই এর নামকরণের তাৎপর্য ও সার্থকতা৷

টপ্পা,ঠুংরী,খেয়াল,গজল,কাওয়ালী,বাউল,ভাটিয়ালী,ঝুমুর,কীর্তন,ভাঙ্গা কীর্তন ইত্যাদি বর্ণসমারোহে পরিব্যাপ্ত প্রভাতসঙ্গীত৷ শ্রীসরকার ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান, পারসিক, আইরিশ, মধ্য এশীয়, চাইনিজ, আইবেরিয়ান ইত্যাদি সুরের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় ও লোকসঙ্গীতের সুরের সুমধুর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন৷ শ্রীসরকার তাঁর সঙ্গীত রচনায় এমন কিছু নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন যা আগামী প্রজন্মের গবেষকদের কাছে চর্চা, গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ মিস্টিসিজম, আধ্যাত্মিক দর্শন, আধ্যাত্মিক অনুভূতি, আশাবাদ, সমাজসচেতনতা, আত্মউদ্বোধনমূলক, সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠান, প্রকৃতি, শিশুসঙ্গীত, নব্যমানবতাবাদ,শিবগীতি, কৃষ্ণগীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি সঙ্গীত রচনা করেন৷ ভূমার সঙ্গে মিলনের জন্যে অণুর যে নিরন্তর ও বিরামহীন প্রয়াস’ একেই তিনি ‘মিস্টিসিজম’ নামে অভিহিত করেছেন৷ ঋতুচক্রের উপর তাঁর বিভিন্ন রচনাগুলি নিবিড় ও গভীর আধ্যাত্মিক আকুতির স্পন্দনে অনুরণিত৷ তাঁর সঙ্গীত রচনার বিষয়বস্তু ভাব ও অস্তিত্বের সামগ্রিকতার পরিসরে পরিব্যপ্ত৷ শুধু তাই নয়, এর বিস্তৃতি এই সীমারেখাকে অতিক্রম করে প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ, এমনকি অচেতন জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুর অস্তিত্বেও প্রসারিত হয়েছে৷ তাই তাঁর সঙ্গীত ‘নব্যমানবতাবাদী সঙ্গীত’ হিসেবেও অভিহিত করা যায়৷ সর্র্বেপরি মনে রাখতে হবে যে প্রভাতসঙ্গীতের মূল বিষয় হল ‘ভক্তি’৷ ভক্তিই এর উপজীব্য ও মর্মনির্যাস৷ এই সঙ্গীতের প্রতিটি ছত্র ভক্তিতরঙ্গের স্পন্দনের স্পন্দিত ও অনুরণিত৷ যুক্তিবর্জিত অন্ধভক্তি নয়, প্রভাতরঞ্জন সরকারের এই ‘ভক্তি’ হল জীবনমুখী ভক্তি, যা শুধু মানুষ নয়, সৃষ্টির চর-অচর সমস্ত কিছুর প্রতি সমান ভালোবাসার আদর্শের প্রতি একান্তভাবেই দায়বদ্ধ৷ এই যে সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা ভক্তিতত্ত্বের এই অভূতপূর্ব উপস্থাপনা চিন্তার জগতে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের এক অনবদ্য ও মৌলিক অবদান৷তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি প্রতিটি মানবহৃদয়ে ‘ভক্তির মঙ্গলদীপ’ প্রজ্জ্বলিত করতে চেয়েছেন৷ কারণ ব্যষ্টি ও সমাজ জীবনে উন্নতিতে একমাত্রই ‘ভক্তি’ই হল একমাত্র মাধ্যম ও অবলম্বন৷ প্রচলিত শিল্পকলার তত্ত্বের বাইরে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার শিখিয়েছেন ‘সেবায়ৈ কল্যাণায় চ কলা’ অর্থাৎ শিল্পকলার মূল লক্ষ্য সেবা ও কল্যাণ৷ এই তত্ত্বই প্রতিফলিত হয়েছে ‘প্রভাতসঙ্গীতে’৷ প্রভাতসঙ্গীতের সুরমাধুর্য, বাণীর উৎকর্ষ, ব্যাপ্তির ঐশ্বর্য, ছন্দের প্রাণচঞ্চল্য ও ভাবের অতলস্পর্শী গভীরতায় আকৃষ্ট হয়ে আপনারা এগিয়ে আসুন, প্রভাতসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত আনন্দ উপভোগ করে হৃদয়কে সিঞ্চিত ও রসনিষিক্ত করুন৷ ‘প্রভাতসঙ্গীতে’র অভ্যন্তরে যে অসংখ্য মহামূল্যবান মণি-মাণিক্য লুকিয়ে রয়েছে, গবেষণার মাধ্যমে সেগুলি মানবতার সেবার কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের৷ ধন্যবাদ৷ (বিঃদ্রঃ বিশিষ্ট ‘প্রভাতসঙ্গীত গবেষক’ ও শিল্পী আচার্য প্রিয়শিবানন্দ অবধূত রচিত কয়েকটি প্রবন্ধ বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে)