আজকে সারা দেশজুড়ে, শুধু দেশ নয়, সমগ্র মানবসমাজ জুড়েই দেখা দিয়েছে এক ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক অবক্ষয়৷ সংস্কৃতি কী? মানব মনের সামূহিক অভিব্যক্তির মধ্যে যে পরিশীলিত ভাব তা–ই হ’ল তার সংস্কৃতি৷ মনুষ্যেতর জীবের চিন্তাধারা তার দেহগত সুখকে অতিক্রম করতে পারে না৷ খাওয়া, ঘুমানো ও সংখ্যাবৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোন ভাবনা তাদের মধ্যে নেই৷ মানুষের মনের অধিকতর সূক্ষ্ম ও মাধুর্যপূর্ণ অভিব্যক্তিই তাকে মনুষ্যত্বের শিরোপা পরিয়েছে৷ এটাই মানবীয় সংস্কৃতি৷ যদিও অভিব্যক্তির ধরণ ধারণ দেশ–কাল–পাত্রে কিছুটা ভিন্নতা প্রাপ্ত হয়, তাহলেও ভেতরের মূল ভাবটুকু এক৷ সাধারণভাবে একেই বলব মনুষত্ব বা মানবিকতা৷ তাই প্রাউট–প্রবক্তা বলেছেন, মানুষের সংস্কৃতি একটাই, অনেক নয়৷ আর তা হ’ল মানবসংস্কৃতি৷
নানান কারণে, এই মানবসংস্কৃতিতে আজ দেখা দিয়েছে অবক্ষয়৷ তাই আজ দেশের–রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত দেখা দিয়েছে মানবিকতার–নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, যা এক কথায় আজকের সমাজের সুসভ্য মানুষের কাছে মোটেই কাম্য নয়৷ সমাজের রক্ষকই আজ হয়ে উঠেছে ভক্ষক৷ অর্থের লোভে বাবা–মাকে খুন করার ঘটনাও চলছে৷ আজকের সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় খুন–ধর্ষণ–দুর্নীতি–এমনি কত কিছু কেলেঙ্কারীর সংবাদ৷
কিন্তু কেন? এ মারাত্মক ব্যাধির নিদান কী? বিভিন্ন সমাজহিতৈষী বিদ্বজ্জনের অভিমত–সমাজের চরম ভোগমুখীনতা ও লোভই এসবের মূলীভূত কারণ৷ সমাজের সমষ্টি মানসিকতার এই যে অধঃপতন–এই যে উন্মার্গগামী প্রবাহ একে রোধ করার জন্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মনীষী মানুষকে পথ দেখিয়েছেন৷ তাঁরা মানব সমাজের স্মরণীয়–বরণীয়৷
আজ মানব সমাজের এই অবক্ষয়ের যুগে মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, যিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নামেই সমধিক পরিচিত, তিনি দিয়েছেন তাঁর সর্বানুসূ্যত দর্শন৷ যার মূল লক্ষ্য মানব সমাজের সর্বাত্মক অগ্রগতি৷ আর সবশেষে সাংস্কৃতিক জগতের আজকের এই অমানিশা সরিয়ে নবপ্রভাতের সূচনা করার জন্যে তিনি অভিনব ভাব–ভাষা–সুর ছন্দের সমন্বয়ে দিয়েছেন ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷
মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে, স্থূল জড়ত্বের অন্ধকার দূর করে’ সেখানে আলোর ঝর্ণাধারার আকুতি জাগাতে হবে৷ এ আলো নিঃসন্দেহে মানসাধ্যাত্মিক জাগরণের আলো–অমল চৈতন্যের শুভ্র দ্যুতি৷ তাই প্রভাত সঙ্গীতের প্রথম গানেই মানবতার সেই আকুতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে–
‘‘বন্ধু হে, নিয়ে চল৷
আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷৷
আঁধারের ব্যথা আর সয় না প্রাণে৷৷
ঘুমের ঘোর ভাঙ্গানোর গানে গানে’’৷৷
তৃতীয় গানটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নব্যমানবতাবাদের ভাব–
‘‘আঁধার শেষে আলোর দেশে
অরুণ ভোরের কথা
(ভাই) শোনাবো সবায় ডেকে ডেকে৷’’
এমনি করে প্রভাতসঙ্গীতকার ৫০১৮টি গানের ডালি উপহার দিয়েছেন মানব সমাজকে৷ গানের ভাষায় তিনি সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন–
এগিয়ে চল এগিয়ে চল
সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চল৷
রক্তিমারুণ সামনে দাঁড়িয়ে
তাহারই পানে এগিয়ে চলো৷
দেশে দেশে যাও ভাইয়ের মতন
সবাকার ব্যথা করিয়া স্মরণ
বিশ্ব মানব পরিবার আজ
তোমাকে ডাকিছে আঁখি ছলো ছলো৷
এ হ’ল রেনেশাঁর–সর্বাত্মক নবজাগরণের সঙ্গীত–যা হতাশাগ্রস্ত মানুষকে আশাবাদের গান শোনায়–
‘‘কে যেন আসিয়া কয়ে গেছে কানে
নূতন প্রভাত আসিবে৷
কালো কুয়াশার যবনিকা পরে
সোনালী জীবন হাসিবে৷’’
‘প্রভাত–সঙ্গীত’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও তিরুপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন আচার্য ডঃ রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘অতিমানসের সঙ্গীত রচনা করেছেন আনন্দমূর্ত্তিজী৷ ছন্দ, শব্দ সৌকুমার্য, অর্থগৌরব–এই সমস্তের সমন্বয়ে অদ্ভুত শিল্পসৃষ্টি, শিল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে ভূমার প্রতিমূর্ত্তি, প্রতিফলন৷ বর্তমানের অবক্ষয়ের যুগে প্রভাত–সঙ্গীত নূতন যুগের সূচনা করে দিতে পারে যদি আমরা তার অনুধ্যান করি–অনুশীলন করি৷’’ ‘‘আনন্দমূর্ত্তিজীর প্রভাত–সঙ্গীত আমরা যতই অনুধ্যান করব, শ্রবণ করব, তার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করব, ততই আমরা আমাদের সংকীর্ণ অহংসত্তাকে অতিক্রম করে একটা বৃহত্তর সত্তায় মিলিত হতে পারব যেখানে–সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই৷’’
এইভাবে প্রভাতসঙ্গীতের মাধ্যমে সমাজে আসবে যথার্থ সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা আজকের অবক্ষয়ের অন্ধকার গহ্বর থেকে উদ্ধারলাভের জন্যে একান্তই প্রয়োজন৷
- Log in to post comments