প্রকৃত জনগণতন্ত্রের শাসন চাই

লেখক
প্রভাত খাঁ

আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি হল না যাকে দেখে অন্য রাষ্ট্রগুলি উন্নয়নের পথে ও আদর্শের পথে চলবে৷ অনেকেই মনে করেছিল ভারতবর্ষের ধ্যান–ধারণা ও মুনি–ঋষিদের মহান মুক্তির বাণী হয়তো পৃথিবীর মানব সমাজকে এক নব দিগন্তের পথ দেখাবে৷ কিন্তু বাস্তবে তা হ’ল না৷ তার মূল্যায়নটি হ’ল যেসব দেশনেতা ও নেত্রীরা এদেশের রাষ্ট্রশাসনে এলেন তাঁদের মধ্যে সেই শৌর্য–বীর্যের বড়ই অভাব ছিল৷ তাঁরা সকলেই সেই সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্রের তল্পিবাহকদের পথ অন্ধভাবে অনুসরণ করে এদেশের মহান ভাবাদর্শকে অজ্ঞানতাবশতঃ পশ্চাতে ফেলেই চলেছেন৷ তাই ভারতে মহান আদর্শ বিশ্ব দরবারে উপস্থিত হওয়ার কোন সুযোগ পায়নি৷ কবির কথায় বলা যায়–আবার ভারত জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে৷ এরজন্যে দেশনেতা ও নেত্রীদের যে আন্তরিক শুভ প্রচেষ্টার দরকার ছিল তা হয়নি৷ যে কটি দেশনেতা ও নেত্রী আমরা দেখলুম, তার মধ্যে কোন ব্যষ্টি যোগ্য ছিলেন না ও যোগ্য নন৷ কুৎসিৎ নোংরা, জঘন্য দলতন্ত্রই ভারতকে মহান গণতন্ত্রের পথকে বিপথগামী করে তুলেছে ও তুলছে৷ মহান গণতন্ত্রের মূল বাণী গণতন্ত্র জনগণের, জনগণের জন্যে ও জনগণের দ্বারা এটাকে নেতা নেত্রীরা করে ছেড়েছেন গণতন্ত্র দলের, দলের জন্যে ও দলের দ্বারা৷ এই উদ্দেশ্যেই ধান্দাবাজ নেতা–নেত্রীরা ছল, বল কৌশল, পেশীশক্তি, ছাপ্পা ভোটে গদীর লড়াইয়ে ব্যস্ত৷ অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার কথা তা হ’ল অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্থাৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনয়ন না করে নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেতে মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্ধ নেতা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করে চিরকালের মত সর্বনাশ করেই ছেড়েছেন৷ যিনি দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সেই মহান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে কুইসলিং ও তোজোর কুকুর বলে কুৎসিৎ বাক্য উচ্চারণ করে স্বার্থান্বেষীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করে গেছেন৷ তারা যে সবাই দেশের বিশ্বাসঘাতক সে কথা বর্তমান খণ্ডিত ভারতের কোটি কোটি জনগণ অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করছেন, আর চোখের জল ফেলছেন৷

গণতন্ত্রকে সফল ও সার্থক করতে গেলে প্রথমেই যা দরকার তা হ’ল সুশিক্ষিত সচেতন নাগরিক তৈরী করা আর প্রতিটি নাগরিক যাতে আর্থিক স্বনির্ভর হয়ে স্বাধীনভাবে ভাল মন্দের বিচার করতে পারে তার সুরাহা অদ্যাবধি এদেশের দলীয় শাসকগণ করতে সক্ষম হননি৷ তার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলি দুর্নীতি ও শোষণের আখড়া হয়ে উঠেছে৷ যে রাজনীতিতে একদিন স্বনামধন্য ব্যষ্টিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই রাজনীতিতে আজ অর্থকৌলিন্যে উন্নত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যষ্টিরা শোভাবর্ধন করছে৷ আজ দেশ ও দেশকে যারা চেনেই না তারা রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষক হয়ে অর্থবলে রাজনৈতিক নেতা ও নেত্রী হচ্ছে৷ আর একদল আছেন যাঁরা বংশপরম্পরায় দলকে নিয়ন্ত্রণ করে পারিবারতন্ত্রকে জিইয়ে রেখে দেশকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছে৷ তাই দেশের সার্বিক কল্যাণে দেশের কোটি কোটি জনগণকে শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিংসা ও বাসস্থান হতে বঞ্চিত করে নিছক বয়সের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দানের সুযোগ দিয়ে এক পঙ্গু গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক নেতা–নেত্রীরা সেই মধ্যযুগীয় ভাগ্য বিধাতা হয়ে রাজসুখ ভোগ করছে৷ শুধু বাগাড়ম্বর আর মিথ্যা প্রতিশ্রুিতির বুলি আউরে দেশটাকে রক্তশূন্য করে ছাড়ছে৷ এদেশে বর্তমানে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের বাস৷ ভারত পৃথিবীতে বৃহত্তম গণতন্ত্র রাষ্ট্র৷ কিন্তু মুষ্টিমেয পিছু পরিবার দেশের ৫০ শতাংশ সম্পদের অধিকারী আর বাকী কোটি মানুষের নুন আনতে পান্তা জোটে না৷ মনে পড়ে স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিকে রাশিয়ার বুলগালিন ও ক্রুশ্চেভ ভারতে এসেছিলেন৷ ডঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী৷ বিদেশের নেতাদের কাছে দেশের মান–সম্মানকে তুলে ধরতে হতভাগ্য ভিখারীদের রাস্তাঘাট থেকে সরিয়ে টিনের দেওয়াল দিয়ে কলকাতার মাঠে আটক করে রাখা হয়৷ কিন্তু আজ কত বছর হয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ যে শিশুরা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট জন্মেছে তাদের বয়স হয়ে গেল ৭৭ বছর৷ সে এখন বৃদ্ধ৷ কিন্তু তাদের অধিকাংশের আর্থিক ও সামাজিক অধিকার রক্ষায় এদেশের সরকার কতটুকু কী করেছেন তার হিসাব কি দিতে সক্ষম হবেন সেদিন কিছু রাজনৈতিক নেতাদের মনে দেশ শাষণের প্রবল আকাঙক্ষা জাগে৷ তাঁরা দেশের ভূত ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে দেশকে ভাগ করো বসেন ইংরাজের কূটনৈতিক চালে৷ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ভাগ হ’ল দু’ভাগে৷ এক বাঙলা ও দুই পঞ্জাব৷ পঞ্জাবের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হ’ল কিন্তু হতভাগ্য পূর্ব বাংলা (বাঙলাদেশ) থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যা আজও সমাধান হ’ল না৷ সীমান্তে পাকিস্তান প্রতিদিন গোলাগুলি ছুঁড়ছে, আর সশস্ত্র জেহাদী অনুপ্রবেশকাররীদের ভারতে জোর করে প্রবেশ করিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে চরম ক্ষতিসাধন করছে৷ ভারতের সীমান্তরক্ষীদের ও নাগরিকদের অকারণে দিনের পর দিন অকারণে হত্যা করে চলেছে৷ বর্তমানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো শুধু দলীয় কোন্দলে ব্যস্ত৷ বর্তমানে চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দেশ ক্ষতবিক্ষত৷ চরম বেকার সমস্যায় জনগণ অধিকাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে ভিখারীর মতই দিনযাপন করছে৷ কৃষি প্রধান ভারতে কৃষির যেমন উন্নতি ঘটিয়ে কৃষি সহায়ক ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলাই উচিত ছিল অদ্যাবধি তা হয়নি৷ ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনাগুলি কাগজে কলমে আটকে আছে৷ গণতন্ত্রকে সার্থক করতে অর্থনৈতিক শোষণ দূর করতে যে ব্যাপক ব্লক ভিত্তিক সমবায় আন্দোলনকে বাস্তবায়িত করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো উচিত ছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তা করে নি৷ দেশের ঋণের বোঝা বেড়েছে শাসকদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে৷ সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়েছে৷ এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কোটি কোটি মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বাস করছে৷ এর পরিবর্তন আশু প্রয়োজন৷ যেভাবে দেশ শাসিত হচ্ছে সেটার সংস্কার দরকার৷ আর্থিক উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়া দরকার৷ কুটির শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে বেকার সমস্যা দুরীকরণে সচেষ্ট হতে হবে৷

এখন প্রশ্ণ হচ্ছে করতে হবেগ কে করবে গণতন্ত্রে আত্মনিবেদিত সেবকগণ যখন শাসনের দায়িত্ব নেন তখন এই দায়িত্ব তাঁদের কিন্তু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা কায়েম করে বুড়ো আঙ্গুল দেখান৷ শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রে নিজেদের মতামত প্রকাশের আন্দোলন করে থাকেন৷ সেই মতামতকে সরকার মূল্য দেন৷ কারণ সরকার মূলতঃ জনগণের কিন্তু এদেশের গণতন্ত্রে দলতন্ত্র এমনই ভয়ংকর যা কহতব্য নয়৷ বিরোধীদের এদেশের গণতন্ত্রে অনেক রাজ্যেই কোন পাত্তাই দেয় না৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই রাজ্যে বামফ্রণ্ট শাসনে তো জ্যোতি বসু গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারেন৷ স্বরাষ্ট্র, পুলিশ প্রশাসন ও প্রচার বিভাগকে কব্জা করে বাম আমলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন৷

এদেশের গণতন্ত্রে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, নানান ধরণের অসৎ কর্মে দলীয় শাসকগণ সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছে ও দিচ্ছে৷ এই ধরণের গণতন্ত্র হ’ল ধান্দাবাজদের স্বর্গরাজ্য৷ ধনীর অর্থেই নির্বাচন ও দল পুষ্ট হয় তাই ধনীদের দিকে নজর দিয়েই সরকার চলে৷

ভারতে হত দরিদ্র অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রিত অর্থনীতির খোলনলচে পালটে প্রাউটের নির্দেশিত পথে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে৷ যার মূল লক্ষ্য থাকবে প্রতিটি মানুষের হাতে জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির আর্থিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া৷ অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের যাতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, প্রত্যেক কর্মক্ষম ব্যষ্টি রুজি–রোজগারের সুযোগ পায় সেই কারণেই বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্যে ব্লকভিত্তিক সমবায় আন্দোলনকে সফল করতে হবে৷ সমবায় প্রাথমিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বণ্টনে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ সমবায়গুলিতে কোনভাবেই বহিরাগতরা স্থান পাবে না৷ ১০০ শতাংশ স্থানীয় বেকারদের নিয়ে সমবায়গুলি গড়ে তুলতে হবে৷ এতে করে বেকার সমস্যা নিয়ন্ত্রিত হবে, অর্থনৈতিক স্বাধীকার প্রতিষ্ঠিত হবে ও জনগণ আর্থিক মুক্তি পাবে৷ তবে সমবায়ের ক্ষেত্রে পরিচালকবৃন্দকে ও সমবায়ের প্রতিটি সদস্যকে কঠোরভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ নতুবা সমবায় আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে৷ অন্যদিকে দলতন্ত্রের শোষণ থেকে নাগরিকদের মুক্ত করতে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য৷ এর জন্যে আন্তরিক প্রয়াস চালানোটাই জরুরী৷