প্রসঙ্গ ঃ মূর্ত্তির সম্মান

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই একটি সংবাদে সারা দেশ তোলপাড়৷ ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে পঁচিশ বছরের বাম রাজত্বের অবসান হওয়ার পর ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গোষ্ঠী সংঘর্ষ, রাজনৈতিক অফিস ভাঙচুড়, অগ্ণি সংযোগ ইত্যাদি অশান্তির ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেনিনের মূর্ত্তি ভাঙ্গার ঘটনা আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সারা দেশে কোথাও লেনিন-মার্কস, কোথাও শ্যামাপ্রসাদ, কোথাও গান্ধী-নেহেরু বা অন্যান্য গুণীজনের মূর্ত্তিতে ছেনী-হাতুড়ীর আঘাত, কোথাও মূর্ত্তি ও ফলকে কালিলেপন আবার কোথাও গঙ্গাজল-দুগ্দামৃত দিয়ে মূর্ত্তি শোধন প্রভৃতি ঘটনাক্রমের জন্য আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে৷ অত্যুৎসাহী, উন্মার্গগামী কিছু মানুষের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্যে বৃহত্তর সমাজের সাধারণ মানুষজনকে বিভিন্ন অশান্তি ও ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়৷ অবশ্য এর আগেও ২০১১ সালে পশ্চিম বাঙলায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ও বহু স্থানে মার্কস-লেনিন মূর্ত্তি ভাঙ্গার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে৷ তারও পূর্বে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় স্কুল পোড়ানো, মূর্ত্তি ভাঙ্গা, কালি লেপন ইত্যাদি ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এ রাজ্যের মানুষ৷ এইসব ঘটনার সময়কাল বা প্রেক্ষিত যাই হোক না কেন---নিঃসন্দেহে এগুলি কলঙ্কময়, অনভিপ্রেত, ধিক্কারজনক ঘটনা ও সভ্য সমাজে অচল৷

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিবর্ত্তনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে মানুষ, নিজেদের প্রয়োজনেই তৈরী করেছে সমাজ৷ বৈচিত্রময় বিভিন্ন মানসিকতা ও কর্মকুশলতা সমৃদ্ধ বহু মানুষ একসাথে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে একই আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্যে যে সম্মিলিত প্রয়াস চালায়, তার ফলেই সৃষ্ট হয় সমাজ৷ স্থান-কাল-পরিবেশ অনুযায়ী এই সমাজের চরিত্রও হয় বিভিন্ন, কিন্তু সমাজে অবস্থিত প্রতিটি মানুষের মঙ্গল সাধনই হ’ল প্রত্যেকের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ আর সমাজেরই কিছু উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন জ্ঞানী-গুণী মনীষীগণ তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মধারা, ত্যাগ-সেবা-সাধনার দ্বারা সকল মানুষের মঙ্গল সাধনে বিশেষভাবে প্রয়াসী হন ও আত্মনিয়োগ করেন৷ সমাজের উপকৃত মানুষজন সেইসব মনীষীগণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিমিত্ত প্রস্তর বা ধাতু নির্মিত মূর্ত্তি বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে৷ নির্দিষ্ট বিশেষ দিনগুলিতে সেই সকল মূর্ত্তিতে মাল্যদান ও অন্যান্য কার্যক্রমের দ্বারা মনীষীগণকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও স্মরণ করা হয়৷ এই মূর্ত্তি স্থাপন কখনও সরকারী উদ্যোগে আবার কখনও বিভিন্ন বে-সরকারী উদ্যোগেও হতে পারে৷ কিন্তু উদ্দেশ্য সবক্ষেত্রেই এক---তা হ’ল মনীষীগণকে শ্রদ্ধা জানানো৷ কোনও মনীষীর কর্মধারা, জীবনাদর্শ, ধ্যান-ধারণা সকলের মনঃপুত না হতেই পারে কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে তাঁর মূর্ত্তিতে কালি লেপন, ছেনী-হাতুড়ী দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা বা ভেঙ্গে ফেলা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়---বরং এগুলি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত৷ আমি কাউকে সম্মান নাও জানাতে পারি, কিন্তু তাঁকে অপমান, অসম্মান করার অধিকার আমার নেই---নীতিগত বা আইনগত উভয় দিক থেকেই৷

তবে আমাদের একথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে, সরকারী বা বে-সরকারী যে কোনও উদ্যোগেই মূর্ত্তিস্থাপন করা হোক না কেন---কেবল মূর্ত্তি স্থাপনেই যেন কর্ত্তব্য শেষ না হয়৷ মূর্ত্তিগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা ও দৃষ্টিনন্দন বিষয়গুলির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন৷ প্রায়শঃই দেখা যায়, মূর্ত্তিগুলির ওপর কাক-পক্ষীকুলের বিষ্ঠা ও নোংড়া নিক্ষেপ, চার পাশে আগাছা-জঞ্জালের ছড়াছড়ি, ধূলা-ঝুলেতে বিবর্ণ অবস্থা---মনীষী, মহাপুরুষদের মূর্ত্তির প্রতি এই অবহেলা কখনই কাম্য নয়৷ সরকারী উদ্যোগে যে সমস্ত মূর্ত্তি স্থাপিত হবে তার পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে---বিভিন্ন পুরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েৎ ইত্যাদি স্তরে, কারণ সারা দেশের সর্বত্রই পুরসভা বা পঞ্চায়েতের সদস্যরা উপস্থিত আছেন৷ আর অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে৷

কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারী কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে (শত-শত কোটি পর্যন্ত) কোনও দেশনেতা বা বরেণ্য ব্যষ্টির বিশালাকার মূর্ত্তি স্থাপন করা হয়৷ এই ধরণের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ছাড়া অন্য কিছু থাকলে তা অবশ্যই বর্জনীয় কারণ বিশাল আকৃতি ও বিপুল অর্থব্যয় কখনোই শ্রদ্ধার মাপকাঠি হতে পারে না৷ এটি হয়একমাত্র ক্ষমতা প্রদর্শন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মানসিকতা বা অন্য কোন সঙ্কীর্ণ স্বার্থজনিত কারণে৷ সরকারের কোষাগারে জনগণের করের মাধ্যমে বা দানে যে অর্থ আসে তার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশের জনগণের অবস্থার উন্নয়ন ও মঙ্গলসাধন৷ সেই অর্থ যদি উন্নয়ন ব্যতিরেকে অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয়িত হয় তবে তার ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয় ও তা’ সাধারণ মানুষের কল্যাণের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে৷ কোন ব্যষ্টিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধি ও প্রচারের উদ্দেশ্যে সরকারী কোষাগারের অর্থ মূর্ত্তি স্থাপনের জন্যে ব্যয়িত হলে পরবর্তী সময়ে অপরপক্ষ বা এই ধরণের অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যয়ের বিরোধী পক্ষ সরকারে ক্ষমতাসীন হলে মূর্ত্তিভাঙ্গা বা বিকৃতির আশঙ্কা থাকার সম্ভাবনা সমধিক,  যার ফলশ্রুতিতে আইন-শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির অবনতি ও অশান্তি হতেও পারে৷ ভারতবর্ষের মত দেশ যেখানে এখনও সব মানুষের জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান- চিকিৎসা-শিক্ষার পূর্ণ ব্যবস্থা হয়নি, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব, বেকারিত্ব, দারিদ্র্য ও অসম সম্পদ বণ্টন ভীষণভাবে প্রকট, সেখানে এই ধরণের বাহ্যাড়ম্বর সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়৷ শুধু তাই নয়, সেই বিপুল অর্থ দিয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান, সুচিকিৎসার জন্যে হাসপাতাল, মাথা গোঁজার বাসস্থান বা শিক্ষা বিস্তারের জন্যে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব, যার দ্বারা দেশবাসীর কল্যাণসাধন হতে পারে৷ সমগ্র দেশবাসীর সার্বিক মঙ্গলের শপথ নিয়ে প্রশাসনে অধিষ্ঠিত দেশনেতাদের দেশীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা, বিবেচনা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শন অবশ্য কর্তব্য৷

এছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মনীষী-মহাপুরুষদের জীবনী ও জীবনাদর্শের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা দরকার৷ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যষ্টিগণের জন্মদিন, মৃত্যুদিন বা বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিবসে আমরা গান, কবিতা, স্মরণসভা করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ করি৷ কিন্তু তাঁদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে হলে তাঁদের জীবনাদর্শ, ত্যাগ ও সেবার ভাবনায় প্রতিটি দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে, শৈশব থেকেই বিভিন্ন মহাপুরুষদের জীবনী ও জীবনাদর্শ ইত্যাদি পঠন-পাঠনে অন্তর্ভুক্ত করে দেশবাসীর মনে শ্রদ্ধার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখতে হবে, অনুসন্ধিৎসাকে আরো তীব্রতর করতে হবে যাতে তারা ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা করে৷ তাই সমস্ত সঙ্কীর্ণতাবর্জিত মানসিকতার দ্বারা সকল গুণীজনের প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারলেই আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারব আর তখনই সমস্ত মূর্ত্তি ফলকের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হবে৷