প্রসঙ্গ ঃ সিপিআই জাতীয় দলের মর্যাদা হারাল

লেখক
অসিত দত্ত

জাতীয় দলের মর্যাদা হারাল সিপিআই৷ সিপিআই ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি নামে এদেশে পরিচয় দেয়৷ কখনই ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টি নয়৷ দুটি নামের মধ্যে  একটি ফারাক অবশ্যই আছে৷ ভারতের জাতীয়করণ হয়েছে এই অর্থে ভারতীয়৷ অন্য শব্দটি ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি অর্থাৎ জাতীয়করণ হয়নি৷ ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি বা সিপিআই এর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর৷ কানপুরে একটুপার্টি কংগ্রেসের বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (মানবেন্দ্রনাথ রায়) অবণী মুখার্জী প্রমুখ এই কম্যুনিষ্ট পার্টি ঘটন করে৷ শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি তার জাতীয় দলের তকমা হারাল৷ শতবর্ষ বয়স প্রাপ্তির পূর্বে সিপিআই-এর এই অধঃপতনের খবর কম্যুনিষ্টদের কাছে বজ্রাঘাততুল্য৷

১৮৪৮ সালে মার্কস এঙ্গেলস-এর আদর্শে কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্ট প্রকাশিত হয়৷ যার মাধ্যমে ঘোষনা করা হয় বুর্র্জেয়া ও প্রোলেত তারিয়েত শ্রেণীর সংগ্রামের মাধ্যমে বুর্র্জেয়া শেষ হবে ও সমাজতন্ত্র আসবে৷ যার শেষে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হবে৷ ১৯১৭সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে শোভিয়েত রাশিয়াতে কমিউনিষ্টরা লেলিনের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে৷ এরপর চীন, ভিয়েতনাম,কোরিয়া সহ ইয়ূরোপের বহু দেশে কমিউনিষ্টরা ক্ষমতা দখল করে৷ কমিউনিজম কায়েম করার জন্য সারা বিশ্বে প্রায় ১০কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়৷ একসময় মনে হয়েছিল সারাবিশ্বে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হবে৷ আমাদের দেশের বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম করবেন এই চিন্তায় বিদেশ পাড়ি দেন৷ তারপর নানা ঘটনার পর তিনি মেক্সিকোয় উপস্থিত হন ও মেক্সিকান স্যোস্যালিষ্ট পার্টি ঘটন করে তার সেক্রেটারী পদে অধিষ্ঠিত হন৷ লেলিনের আহ্বানে তিনি রাশিয়া যান ও কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের সদস্য হন৷ মেধা ও বুদ্ধির জন্য তিনি কমিউনিজমের ওপর যে থিসিস দেন তা রায় লেনিন থিসিস নামে বিখ্যাত৷ মানবেন্দ্ররায়ের  সেখানকার কর্মকাণ্ড এক ঐতিহাসিক ঘটনা৷ কিন্তু লেলিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি ভারতে চলে আসেন৷ এখানে অন্যান্যদের সহযোগিতায় কংগ্রেস পার্টি গঠন করেন,যা পূর্বে বলা হয়েছিল৷ এরপর কংগ্রেসে যোগ দেন ও স্যোসালিষ্ট ফ্রন্ট ঘটন করেন৷ হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচনে গান্ধী মনোনীত সীতারামাইয়ার বিরুদ্ধে  প্রার্থী সুভাষচন্দ্রের পক্ষে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়৷ তিনি কমিউনিজমের ত্রুটি গুলি বুঝে ছিলেন তাই পরবর্তীকালে র‌্যাডিকাল হিউম্যানিজম প্রতিষ্ঠা করেন৷

স্বাধীনতার পর কমিউনিষ্ট পার্টির শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে৷ ১৯৫৭ সালে কেরলে ই.এম.এস নামুদ্রিপাদকে মুখ্যমন্ত্রী করে সিপিআই সরকার ঘটন করে৷ এরপরও তাদের অগ্রগতি চলতে থাকে৷ ইতিমধ্যে ভারতের ওপর চিনের আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে কমিউনিষ্ট পার্টির মধ্যে সৃষ্টি হয় ও ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে সিপিআই বিভক্ত হয়ে যায় ও তৈরী হয় সিপিআইএম---কম্যুনিষ্ট পার্টি অফ মার্কসবাদী, পরবর্তীতে কমিউনিষ্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে আরও কয়েকটি দল গঠিত হয়৷ ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়৷ যার পুরভাগে ছিল সিপিআই এম৷ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর কমিউনিষ্টদের রক্তলোলুপ পাশবিক চেহারা প্রকাশ পায়৷ ১৯৬৭ সালে ৫ই মার্চ আনন্দনগরে  আনন্দমার্গের ৫জন সন্ন্যাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কমিউনিষ্টরা৷ বর্ধমানের সাঁইবাড়িতে সন্তানকে হত্যা করে তার বুকের রক্ত মায়ের মুখে ছিটিয়ে দেওয়ার মত পাশবিক কাজ করতে কমিউনিষ্টরা দ্বিধাবোধ করেনি৷ ১৯৭৭ সালে এমারজেন্সির অন্ধকার পেরিয়ে কমিউনিষ্টরা পশ্চিমবঙ্গে আবার ক্ষমতায় আসে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ঘটন করে৷ টানা ৩৪ বছর রাজত্বে বিজনসেতুতে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী হত্যা, মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু হত্যা থেকে শুরু করে বানতলা,বিরাটি,তারকেশ্বর,সিঙ্গুর,নন্দীগ্রাম, সুচপুর...পশ্চিমবঙ্গ বদ্ধভূমিতে পরিণত হয়৷ সারা বিশ্বে যেখানে কমিউনিষ্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে একই চিত্র৷

একথা পূর্বেই বলেছি একটা সংঘটনে কমপক্ষে তিনটি বিষয় থাকতে হবে৷ প্রথম-আদর্শ, দ্বিতীয়-আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য উপযুক্ত নেতৃত্ব ও তৃতীয়-মজবুত সংঘটন৷ দুঃখের বিষয় কমিউনিষ্ট পার্টি আদর্শ মার্কসবাদ ত্রুটিপূর্ণ ও মানুষের কল্যাণকামী নয়৷ দ্বিতীয় বিষয় নেতৃত্ব---কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্ব কখনই মানবতাবাদী নয়---জড়বাদী এরা কখনও মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ করতে পারেনা৷ তৃতীয়-সংঘটন --- কমিউনিষ্ট পার্টির একটা মজবুত সংঘটন ছিল যা একটা ডাকাত দলের সমতুল্য৷ তাই মানব সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ কমিউনিষ্ট দের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়৷

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তথা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর ও আনন্দমার্গের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়ে গেছে কমিউনিষ্টরা ও তৎকালীন দিল্লীর শাসক৷ সেই প্রসঙ্গে একদিন শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছিলেন ‘‘মার্কসবাদ মরে গেছে, কমিউনিষ্টরাও একদিন শেষ হয়ে যাবে৷’’ তার সেদিনের ভবিষ্যৎবাণী যে বিফল হয়নি তার প্রমাণ সোভিয়েত ইয়ূনিয়নসহ ইয়ূরোপের দেশগুলি থেকে কমিউনিষ্টদের অবলুপ্তি ও ভারতবর্ষেও আজ তারা মৃত্যু পথ যাত্রী৷ আজ ভারতবর্ষে কমিউনিষ্টদের শেষ বাতি কেরলে টিম টিম করে জ্বলছে৷ তাও একদিন নিভে যাবে৷