প্রত্যেক নাগরিককে স্বনির্ভর করাই হল গণতন্ত্রের লক্ষ্য

লেখক
প্রভাত খাঁ

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে৷ সাত দফা নির্বাচনের ইতোমধ্যে চার দফা শেষ হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গেও শান্তিতে চার দফার ভোট শেষ হয়েছে৷ কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে পরস্পরের প্রতি অশালীন ভাষায় গালিগালাজ ছাড়া জনগণের জীবন যাপনের মান উন্নয়নের কোন বার্র্ত নেই৷ তাই এই আলোচনার বিষয় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য কি হবে৷ বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম যে ভাবে বাড়ছে তাকে সামাল দিতে দারিদ্র্য সীমার নীচে যারা বাস করছে আর নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের যে দারুণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা তাকে মানিয়ে নিয়ে দিন যাপন করাটা দিন দিন অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে মূলতঃ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে ও সমাজের সহানুভূতিশীল মানুষকে৷ তা না হলে সমাজ ব্যবস্থাটাই ভগ্ণ প্রাসাদের মত ভেঙ্গে পড়বে৷ এই করুণ আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাকে মোকাবিলা করাটা সরকারের কর্তব্য৷ প্রধানতঃ শতকরা ৭০ জন লোক যে ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মধ্যে নাকানি চোবানি খাচ্ছে সেটা কিন্তু অজানা নয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির৷ পাঁচটি জিনিস সকলের অত্যাবশ্যক, তা হল অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান৷ এই পাঁচটি নিয়েই চলছে এদেশের ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক ধনী, ব্যবসাদার শ্রেনীর প্রচণ্ড শোসণাত্মক কারবার৷ এই শোষণকে সামান্যটুকুও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কেন্দ্র ও রাজ্য শাসক শ্রেণীর নেই কারণ তাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়েই রাজনৈতিক দলগুলি শাসন চালিয়ে যাচ্ছে৷ প্রতি মাসেই সকল জিনিসের দাম বাড়ছে৷ পাল্লা দিয়ে তোলাবাজিটা এতটাই বেড়েছে যার দরুণ হতভাগ্যরা দিশেহারা৷ এই যে কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার করুণ ছবি সেটাতে আর্থিক বিপর্যয়ের ছবিটাই ফুটে উঠেছে৷ সরকারী নির্দেশ সর্বত্র অমান্য করা হচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যপারে৷ হয়তো কোলকাতায় বা অন্যস্থানের কোনও কোনও জায়গায় কিছু কারবারী সরকারের নির্দেশ মানছে কিন্তু সর্বত্র নয়৷ তাই জনগণ কোনও দিশারই সন্ধান পাচ্ছে না বেঁচেথাকার জন্যে তারা কোন পথে এগোবে৷

বেচার লোক অনেক কিন্তু কেনার লোক কম৷ আয়ের উপায় সিংহভাগ লোকের নেই৷ দেশে দারুণ ভাবে টাকার বিনিময় মূল্য কমেছে৷ ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বছরে কয়েকবার ডি.এ. বাড়িয়ে কর্মচারীদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করছেন৷ কেন্দ্রের সর্বসাকুল্যে এককোটি ছয় লক্ষ্য কর্মচারী পেনশন ভোগী৷ তারা যে বেতন বা পেনশন পাচ্ছেন তাদের চিন্তার কারণ নেই৷ কিন্তু সারা ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে কেন্দ্রের মতই রাজ্য সরকারী কর্মচারী, সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত আধা সরকারী কর্মচারী ও পেনশন ভোগীদের ডি.এ. দিচ্ছেন৷ তাতে তাঁদের কিছু সুরাহা হচ্ছে কিন্তু বেশ কিছু রাজ্য তাঁদের কর্মচারী ও সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থার কর্মচারীদের প্রাপ্ত ডি.এ. দিচ্ছে না বহু বছর ধরে৷ তাঁদের অত্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে বিশেষ করে নিম্ন স্তরের কর্মীদের৷ কিন্তু এই যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারী কর্মচারী তাঁরা সমগ্র দেশের কত শতাংশ অধিকাংশ বেসরকারী ক্ষেত্রে বেতন ও ডি.এ.র কোনও স্থানই নেই৷ অধিকাংশ মানুষ দিন আনা দিন খাওয়ার ওপর নির্ভরশীল৷ তারা বাধ্য হয়ে মজুরী বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের কাজ নেওয়াটাও সম্ভবপর হচ্ছে না৷ বেকার হয়ে পড়ছে অনেকেই৷ ফলে সবক্ষেত্রেই আর্থিক সচলতার দারুণ সংকট৷ এই সংকটের হাত থেকে বাঁচতে বেকার কর্মক্ষম যুবক যুবতীরা নিজেদের বাঁচাতে ও আত্মীয় স্বজনের মুখে দুমুঠো খাদ্য তুলে দিতে বিভিন্ন পথে চলে যাচ্ছে৷ অনেকেই অসাধু পথে চলে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে৷ এর ফলে অনেক পরিবার নানা সমস্যায় পড়ছে৷ ক্রয় ক্ষমতা মানুষের কমে যাচ্ছে৷

এদিকে কিছু টাকা নিম্নমধ্যবিত্তের লোকে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখেছে কিছু সুদ পেতে৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা সুদের হার প্রতি বছরই কেন্দ্র সরকার কমিয়ে তাদের অন্ন সংস্থানের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে৷ যেখানে শতকরা ১২/১৩ শতাংশ সুদ ছিল সেখানে ৬/৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে৷ এতে শোষণটা সেই গরীব মানুষের উপরেই পড়ছে৷ একথা জনকল্যাণমুখী সরকারকে ভাবতে হবে না? জমি, বাড়ী ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে বাধ্য হয়ে অনেকে শ্বাস নিচ্ছে কিন্তু ঋণ শোধ করতে না পেরে তারা সর্বস্ব হারাচ্ছে৷ এটা কেমন সেবামূলক ব্যবস্থা?

স্বাধীনতার অনেক বছর পর কেন্দ্রে কংগ্রেস ও অন্যান্য দলবাজীতে পঙ্গু রাজনৈতিক দলগুলিকে বিদায় দিয়ে বিজেপিকে অনেক আশা নিয়ে সারা ভারতের জনগণ কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে শাসনে বসিয়ে ছিল৷ প্রথমবারের ব্যর্থতা ভুলে মানুষ দ্বিতীয়বারও বিজেপিকে শাসন ক্ষমতায় এনেছে৷ কিন্তু বিজেপি সরকার অদ্যবধি তেমন কোনও সুরাহা হতভাগ্য জনগণকে দিতে পারেনি৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে সরকার বর্ত্তমানকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্য নিধি নিয়ে ব্যস্ত৷ যেখানে রাজ্যগুলিতে বিজেপি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়নি সেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে যেন অহি-নকুল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ সাহায্যের পরিমাণ কেন্দ্র কমিয়ে দিচ্ছে৷ আর রাজ্যগুলি রাজ্য শাসণে দারুণ অসুবিধায় পড়েছে৷ সমস্যা সংকুল পশ্চিমবঙ্গ তারই দৃষ্টান্ত৷ ঋণভারে জর্জরিত এই সমস্যা সংকুল রাজ্য সরকার মানুষকে মোহিত করতে কিছু কিছু কাজ করেছে যেটাতে স্থায়ী সমাধান হয় না তবু মানুষ স্বপ্ণ বিভোর৷ উৎসবে বাঙ্গালীরা অনেকেই মেতে আছে৷ কিন্তু কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নয়নের স্থায়ী কোনও পথের সন্ধান দিতে পারেনি৷ এই রাজ্যের তথা অন্য রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধানের কিন্তু একমাত্র পথ হলো কৃষি ভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা ব্লকে ব্লকে৷ সেটা করতে হবে সমবায় ভিত্তিক৷ গ্রামের মানুষেরাই কাজ পাবে৷ গ্রামগুলাকে আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া অন্য পথ নেই৷ বিভিন্ন দলীয় রাজ্য সরকারগুলি অদ্যাবধি সে পথে হাঁটছেন না কারণ ধনীদের দ্বারাই এরা নিয়ন্ত্রিত৷ আর ধনীরা কখনও সমবায়কে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না কারণ সমাজতন্ত্রের পথটা তো তাদের পথের বিপরীত৷ কারণ শোষণের দ্বারাই এরা এদের সমৃদ্ধির পথ বাঁচিয়ে রাখে৷ তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ুক সেটা তাদের নীতি বিরুদধ৷ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেই আর বোট কুড়ুতে হাস্যকর ৩ বা ২ টাকা কেজি দরে চাল, গম রেশনে ছিঁটে ফোঁটা দিয়ে ঋণের পাহাড় বাড়িয়ে ও ভর্ত্তুকি দিয়ে উন্নতির ফানুষ ওড়াচ্ছে৷

গণতন্ত্রে প্রতিটি নাগরিককে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিতে হয় সরকারকে৷ তারা আয় করে তার ক্ষমতা বাড়িয়ে স্বনির্ভর হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে সেটাই সরকারের পবিত্র কর্ত্তব্য৷ সেটা কোথায় হচ্ছে? শুধু সরকারী কর্মচারীরাই দেশের নাগরিক এমনতো নয়৷ এতে জনসাধারণের ঋণ বাড়ে৷ গণতন্ত্রে নাগরিকগণ সকলে একই ধরণের সুবিধা লাভ করবে৷ নারী-পুরুষ ভেদাভেদ কোনও অবস্থাতে থাকবে না৷ প্রয়োজনে সরকারকে আইন প্রয়োগ করে সেই ভেদাভেদ দূর করতে হবে৷ কোনো সম্প্রদায় বিশেষ অধিকার পেতে পারে না গণতন্ত্রে৷ গণতন্ত্রে সবাই সমান, যদি তা না হয় মনে রাখতে হবে সেই গণতন্ত্রে মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে৷ তবে অত্যন্ত দুঃখের আর বেদনার কথা হল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যারা ভারতকে ভাগ নিজেদের স্বার্থে করেছে তারাই সমগ্র দেশবাসীর চরম ক্ষতি সাধন করছে৷ তাই যাতে আর সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতা বোটের স্বার্থে প্রয়োগ না হয় সেদিকে বর্ত্তমান ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকগণকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে ও ত্রুটিমুক্ত করতে হবে দেশকে৷ নচেৎ আগামী ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন, এটা যেন দেশনেতাদের স্মরণে থাকে৷ তাই ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় এক আইন এক অধিকার, সমান গণতন্ত্রিক অধিকার সকলের জন্য তাই যেন লক্ষ্য হয়৷

বিশেষ করে নারী পুরুষ ভেদাভেদ দূর হোক৷ সকল ভারতীয় যেন এক হয়৷ নিজের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষ নিয়ে যেন নেতারা বেশী মাতামাতি না করেন৷ সবার উপরে দেশ তাহার ওপরে কিছুই নাই৷ নব্যমানবতা জয়যুক্ত হোক৷ সবাইকে বাঁচতে দাও ও নিজে বাঁচো---এটাই হোক আমাদের শ্লোগান৷