(মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর শব্দ চয়নিকা–২৬ খণ্ড গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে ‘নারীর মর্যাদা’ বিষয়ক অনেক কিছুই বলেছেন৷ ওই গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ সংকলিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ –সম্পাদক)
রাঢ়ে যখন পৌরাণিক ধর্ম এল, সে একা আসেনি৷ সঙ্গে নিয়ে এল অজস্র সামাজিক ক্ষত, অজস্র সামাজিক আধি–ব্যাধি৷ প্রাচীনকাল থেকে অর্থাৎ এদেশে আর্যাগমনের সময় থেকে বর্ণ–বিভাজন ব্যবস্থা ভারতের অন্যান্য জায়গার মত রাঢ়েও এসেছিল – একথা আগেই বলেছি৷ কিন্তু বর্ণবৈষম্য মোটেই ছিল না৷ এমনকি এ জাতি, ও–জাতি বিবাহেও কেউ বড় একটা আপত্তি করতেন না৷ কিন্তু যখন পৌরাণিক ধর্ম রাঢ়ে এল, তখন রাঢ়ে পৌরাণিক ধর্মাবলম্বী রাজারা কিছুসংখ্যক গোঁড়া ব্রাহ্মণ ও গোঁড়া কায়স্থের সাহায্যে রাঢ়ের বুকে বর্ণবৈষম্যটা জগদ্দল পাথরের মত চাপিয়ে দিতে চাইলেন৷ ঢ়িলেঢ়ালা বর্ণ–ব্যবস্থাযুক্ত রাঢ় এটা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারল না৷ সমাজে দেখা দিল নানান ধরণের বিশৃঙ্খলা৷
এমনকি ব্রাহ্মণ–ব্রাহ্মণ সম্পর্কজাত যে সমস্ত ‘জাত’ রাঢ়ে তৈরী হ’ল, তাদের কোন্ বর্ণে ফেলা হবে ৰোঝা মুস্কিল হয়ে উঠল৷ একটা অন্যায়কে সমর্থন করতে গিয়ে পৌনঃপুনিকভাবে অনেক অন্যায়কে সমর্থন করতে হয়, একটা মিথ্যাকে সমর্থন করতে গিয়ে অসংখ্য মিথ্যার চেইন তৈরী করতে হয়৷ তেমনি এই অপ্রাকৃত বর্ণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে গেলে আরও কোন নূতন ধরণের বৈষম্যযুক্ত থিয়োরি আবিষ্কার করতে হয়৷ এই অবস্থায় মুস্কিল–আসান হিসেবে এলেন রঘুনন্দন৷ তিনি জাতির পাঁতি খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে বললেন – ‘‘ভারতীয় চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা রাঢ়ে চলবে না৷ এখানে হবে দ্বিবর্ণ ব্যবস্থা – বিপ্র ও শূদ্র৷’’ পৌরাণিক ধর্মাবলম্বী রাজাদের ভয়ে রাঢ়ের জনসাধারণ এই বৈষম্যমূলক জাতিভেদ মুখে মেনে নিয়েছিল, মনে মানে নি৷ রাঢ়ের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হ’ল শূদ্রসম্মত এক মাসের অশৌচ ব্যবস্থা৷
এই রঘুনন্দনীয় ব্যবস্থা রাঢ়ের উপকার করেনি, করেছে বিরাট অপকার৷ কেবল রঘুনন্দনীয় ব্যবস্থাই অভিশাপ হয়ে রাঢ়ে এসেছিল তাই নয়, বর্ণবৈষম্যের মধ্যে এসেছিল কৌলীন্য প্রথা৷ পৌরাণিক ধর্মের অন্ধ সমর্থক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্ত্তন করা হ’ল৷ উদ্দেশ্য ছিল, জোর করে জৈন–বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের ওপরে পৌরাণিক ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া ও তাঁদের গোঁড়া পৌরাণিক ধর্মাবলম্বী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের শাসনাধীন রাখা৷ ব্যবস্থা দেওয়া হ’ল যে কুলীনের মেয়েকে কুলীন ঘরে বিয়ে দিতে হবে, নইলে কৌলীন্য নষ্ট হবে৷ আবার শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণেরা যদি কুলীনে কন্যা দান করেন তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি হবে (ব্রাহ্মণ সমাজে কুলীনকে বলা হয় শ্রোত্রিয় ও কায়স্থ সমাজে অকুলীনকে বলা হয় মৌলিক) এর ফলে হ’ল কি না, একজন কুলীন ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ শতাধিক বিবাহ করতে পারতেন৷ তাঁদের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল৷ পৌরাণিক ধর্মের ধারক ও বাহকের সংখ্যাও বেড়ে চলল৷ আর শ্রোত্রিয় ও মৌলিকের সংখ্যা কমে গেল৷ তাদের ঘরে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না৷ তার ফলে বৌদ্ধ–জৈন প্রভাবও কমে যেতে লাগল৷
সংখ্যা বাড়লেই তো যোগ্যতা বাড়ে না৷ কুলীনের বহুবিবাহের ফলে আর শ্রোত্রিয়–মৌলিকের বিবাহ না হওয়ায় সমাজে নানান ধরণের গ্লানি দেখা দিল৷ এই গ্লানির হাত থেকে কায়স্থ সমাজকে বাঁচাবার জন্যে পাঠান যুগে তৎকালীন বাঙলার প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বসু কায়স্থ সমাজে কৌলীন্য জ্যেষ্ঠপুল্রগত করে দেন৷ কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজে এই ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হয় নি৷ কৌলীন্য প্রথার জন্যে সমাজের একাংশে বহুবিবাহ ও অন্য অংশে অবিবাহের ফলে সমাজে বড় ধরণের গ্লানি ও অবক্ষয় দেখা দিল৷ সমাজকে সেই গ্লানি ও অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে পরবর্ত্তী যুগে রাঢ়ের দেবীবর ঘটক
(বীরভূম জেলা) মেলবন্ধন প্রথা (বারেন্দ্র সমাজে পটিবন্ধন নামে পরিচিত) প্রবর্ত্তন করেন৷ সমাজে গ্লানির হাত থেকে বাঁচবার জন্যে ধর্মান্তর গ্রহণ বা গ্লানির কাছে আত্মসমর্পণ করে পাপ জীবনে যাওয়া, এতে দু’টোরই কিছুটা প্রশমন হ’ল৷ মেলবন্ধনের মানে হ’ল সমদোষযুক্ত বা সমগুণযুক্ত মানুষদের নিয়ে কয়েকটি গোষ্ঠী তৈরী করা ও সেই গোষ্ঠীগুলিকে সমাজের ভেতরে থাকতে দেওয়া৷ যেহেতু সমদোষযুক্ত বা সমগুণযুক্ত ব্যষ্টিদের নিয়ে গোষ্ঠীগুলি তৈরী, তাই কেউ কাউকে অপবাদ দিতে পারত না৷ এই মেলবন্ধন ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ সমাজ প্রাণে বাঁচল বটে, কিন্তু মানে বাঁচল না৷
এই পৌরাণিক ধর্ম রাঢ়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ফলে যে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক গ্লানি দেখা দিল, জনমানসে যে চাপা ক্ষোভ দেখা দিল, তার পরিণাম লক্ষ্য করা গেল কয়েকশ’ বছর পরে পাঠান যুগে ও মহাপ্রভুর আবির্ভাবের সময়ে৷ রাঢ়ের বিক্ষুব্ধ মানুষেরা সেই যুগে হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল অথবা মহাপ্রভু প্রবর্ত্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল৷ বাঙলার বৌদ্ধ প্রভাবাধীন অঞ্চলের মানুষেরা মহাপ্রভুর আগমনের বহু পূর্বেই প্রচুর সংখ্যায় মুসলমান হয়ে গিয়েছিল৷ আর যারা বাকী ছিল তারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করল৷ পশ্চিম রাঢ়ে জৈন প্রভাব বেশী ছিল৷ জৈন ও ইসলামে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার দূরত্বই বেশী৷ তাই পরে পশ্চিম রাঢ়ের মানুষ ইসলাম ধর্ম বড় একটা গ্রহণ করে নি তারা দলে দলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল৷ এর অন্যতম কারণ হ’ল, জৈন ও বৈষ্ণবধর্মের দার্শনিক পার্থক্য যত বেশীই হোক না কেন, বৈবহারিক জীবনে পার্থক্য বেশী নয়৷ এই চাপা ক্ষোভের অন্যতম নিদর্শন পাই রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণে’৷
পৌরাণিক ধর্ম রাঢ়ের বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল৷ রাঢ়ের অমূল্য সম্পদ সমসমাজতত্ত্বের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হেনে তাকে অন্ধকার গহ্বরের অতল তলে তলিয়ে দিয়েছিল৷ বর্ত্তমান রাঢ়ের, বিশেষ করে পশ্চিম রাঢ়ের অনগ্রসরতার যে ক’টি কারণ খুঁজে পাচ্ছি, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পৌরাণিক ধর্ম তার অন্যতম কারণ৷
(‘‘সভ্যতার আদি বিন্দু–রাঢ়’’, ‘বাঙ্লা ও বাঙালী’)