রাণী ভবসুন্দরীর বিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

কোনো রাষ্ট্রশক্তি কিংবা কোনো সাম্রাজ্যবাদী শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে নিয়ে যে বিদ্রোহ তাকেই বলে গণবিদ্রোহ৷ বাঙলা তথা ভারতবর্ষের প্রচলিত ইতিহাসে এই ধরণের গণবিদ্রোহের কথা প্রথম লেখা হয়েছে সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কথা দিয়ে৷ সে বিদ্রোহ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বাঙলা তথা ভারতীয় ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ৷ কিন্তু তার আগের বিস্মৃত অনেক বিদ্রোহের ইতিহাস লেখাই হয়নি৷ হবে কী করে, বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার জন্য যে অতি মানসি প্রজ্ঞাধীসম্পন্ন ইতিহাসবিদের যথেষ্ট অভাব আছে বাঙলা তথা ভারতীয় ইতিহাসে? নইলে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের আগে ঘটে যাওয়া এমন অনেক বিদ্রোহের কথা আছে সেগুলো কেন উঠে আসেনি? এই প্রশ্ণের উত্তরের জন্য আমাদের শিলালেখ, দানপত্র কিংবা প্রশস্তিগাথার বাইরে ইতিহাস খোঁজার অন্য উপাদানের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে৷ মাটির বুকে কান পেতে সমাজ-সংস্কৃতির গভীর থেকে তুলে আনতে হবে সেইসব ইতিহাস৷

বহু অজানা ইতিহাসের সত্য উদঘাটক, প্রজ্ঞাধীসম্পন্ন ব্যষ্টিত্ব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তথা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বিস্মৃত এইসব বিদ্রোহের ইতিহাস তুলে এনেছেন৷ বিস্মৃত ইতিহাসের এই আখ্যানে আমরা আলোচনা করবো প্রাচীন ভূরিশুট পরগণার বীরাঙ্গনা নারী রাণী ভবসুন্দরীর কথা৷ ভূরিশুট পরগণার রাজধানী মন্দারণের পাশে শক্তিগড়ে আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে ভূরিশুট পরগণার দুর্বল রাজা জগৎনারায়ণের রাণী ভবসুন্দরী কীভাবে বিদ্রোহ করে বাঙলার মান বাঁচিয়েছিলেন তার কথা৷ আলোচনা করবো কীভাবে ভবসুন্দরী আকবর কর্ত্তৃক রায়বাঘিনী উপাধিও পেয়েছিলেন তার কথা৷

পূর্বের বিদ্রোহগুলির কথা লেখার সময়ই বলেছি, পৃথিবীর বৃহত্তর ব-দ্বীপ ভূমি বাঙলা চিরকালই ছিল উন্নত শস্যভাণ্ডারের  দেশ৷ ফলে প্রাচীনকালের মানুষ যেমন জীবন-জীবিকার জন্য বাঙলায় ছুটে এসেছেন, পরবর্তীকালে শাসক-শোষকেরা ছুটে এসেছেন শাসন-শোষণ করতে৷ মধ্যযুগের বাঙলায় বাঙলার শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত ছিল বর্দ্ধমান৷ সেই শস্যভাণ্ডারের প্রতি নজর পড়লো দিল্লির সম্রাট আকবরের৷ যেকোনো মূল্যে বাঙলার শস্যভাণ্ডার বর্দ্ধমান তাঁর চাই৷ বর্দ্ধমান তখন ভূরিশুট পরগণার রাজা জগৎনারায়ণের অধীন৷ আকবর মানসিংহকে দূত করে সসৈন্যে পাঠালেন ভূরিশুট পরগণায়৷ ভূরিশুট পরগণায় দুর্বল রাজা জগৎনারায়ণ বিনাযুদ্ধে আকবরের বশতা স্বীকারের জন্য শ্বেত পতাকা হাতে এগিয়ে যাবার মনোস্থির করলেন৷ কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন অন্তঃপুরবাসিনী রাণী ভবসুন্দরী৷ তিনি অত সহজে বাঙলার মান বিকিয়ে দিতে রাজি নন৷ তিনি বিদ্রোহ করে বসলেন৷ গোপনে আমর্ত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন ও মানসিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার জন্য গণবিদ্রোহের আয়োজন শুরু করলেন৷ তিনি দ্রুত বাগ্দী বাহিনী ঘটন করে যুদ্ধের জন্য পা বাড়ালেন৷ রাজা জগৎনারায়ণ কারাগার থেকে চীৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘‘ভবী তুই যাসনে৷ তুই সামান্য নারী, আকবরের সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে তুই পারবিনে৷’’

কিন্তু ভবসুন্দরী রাজার কোনো কথাই শুনলেন না৷ তিনি যুদ্ধের জন্য পা বাড়ালেন৷ তাঁর বাহিনির বিভিন্ন যোদ্ধা বর্দ্ধমানের আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুললেন৷ বাগ্দী সর্দার নোয়া দা যেখানে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, সেই জায়গা আজও নোয়াদার ঢাল নামে পরিচিত৷ পিচকারী বাহিনী যেখানে প্রতিরোধ গড়েছিলেন সেই জায়গা এখন পিচকারীর ঢাল নামে পরিচিত৷

রাণী ভবসুন্দরী নিজে নিজে মুখোমুখি হলেন মানসিংহের বিরুদ্ধে৷ কয়েকদিন ধরে চললো তুমুল যুদ্ধ৷ কিন্তু আকবরের বিশাল বাহিনির কাছে ভবসুন্দরী পরাজিত ও বন্দি হলেন৷ মানসিংহ আকবরের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, একজন নারী যুদ্ধ করতে এসে বন্দি হয়েছেন, তাঁকে কী করবো?

একজন নারী আকবরের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে শুনে প্রীত হলেন ও বললেন, রাণী কী চান? মানসিংহ জানালেন রাণী বাঙলার স্বাধীনতা চান৷ একজন নারীর এই সাহসের তারিফ করে আকবর বললেন, নামমাত্র করে বাঙলাকে স্বাধীন করে দিয়ে এসো৷ সেই সঙ্গে তিনি বীরাঙ্গনা এই রাণী ভবসুন্দরী জন্য ‘‘রায়বাঘিনী’’ খেতাবও দিয়ে পাঠালেন৷

আকবর, জাহাঙ্গির সহ অনেককে ঘিরে বর্দ্ধমানের অনেক ইতিহাস লেখা আছে কিন্তু এই রায়বাঘিনী ভবসুন্দরীকে নিয়ে কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি৷ কেন হয়নি? আমার মনে হয়, প্রথমত, প্রাচীন-মধ্যযুগে একে তো ইতিহাস ঠিকমতো লেখাই হয়নি তার ওপর অহংকারী পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর কীর্তিগাথার কথা লেখা হবে এমন কল্পনা করাও দুরাশা! ফলে গৌরাবান্বিত এই ইতিহাস বিস্মৃতই ছিল৷ দ্বিতীয়ত বিস্মৃত এই ইতিহাস তুলে আনার জন্য প্রজ্ঞাধীসম্পন্ন মানুষের  অভাব ছিল৷ তবে স্থান নামের ইতিহাসের মধ্যে, প্রবাদ-প্রবচনের মধ্যে বাঙলার আকাশে বাতাসে কিছু কিছু সূত্র ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ সেই সূত্রগুলি ছিল ‘রায়বাঘিনী’,‘ভবসুন্দরী’, ‘‘ভবী ভুলবার নয়’’, ‘‘শক্তিগড়’’, ‘‘পিচকারীর ঢাল’’, ‘‘নোয়াদার ঢাল’’ ইত্যাদি৷ কিন্তু এতদিন আমরা কান পেতে তা শুনার বা বোঝার চেষ্টা করিনি যে, এই শব্দ বা প্রবাদ প্রবচনগুলি কোন্‌ ইতিহাস বহন করে চলেছে৷ কখনো প্রশ্ণ করে উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি, কে ছিলেন এই  ‘‘রায়বাঘিনী’’? কিংবা কান পেতে শোনার চেষ্টা করেনি ‘‘যতই তেল দাও সিঁদুর দাও ভবী ভুলবার নয়’’, এই ভবী কে ছিলেন? কেন তাকে ভোলানো যায়নি৷ এই সব প্রবাদের অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, এই ভবী আসলে সেই ভবসুন্দরী রাণী৷ যিনি মধ্যযুগের গোড়ার দিকে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ করেছিলেন৷ আর এই বিদ্রোহের বিদ্রোহীরা ছিলেন রাঢ়-সমতটের বাগ্দী-মাহাত বাঙালিরা৷ বিদ্রোহী বাঙলা ও  বাঙালির জীবন ইতিহাসে এও এক গৌরাবান্বিত অধ্যায়!