রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত

লেখক
প্রভাত খাঁ

পৃথিবীর বুকে যত স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে মূলত তা  পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয় কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার  আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই৷ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণই পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে সংখ্যায় বেশী ছিলেন৷ তাই তাঁদের মাতৃভাষা বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হওয়াটা যুক্তিযুক্ত৷ কিন্তু  মিঃ জিন্নার দল সেটিকে  মান্যতা দেননি৷ ঊর্দ্দুভাষাকেই জোর করে রাষ্ট্রভাষা করা হয়৷ এই কারণে পূর্ব পাকিস্তানে ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে ঢাকায় জনগণ সমবেত হন তীব্র প্রতিবাদে৷ এই প্রতিবাদে পাকিস্তানী পুলিশের গুলিতে  তরতাজা পাঁচজন তরুণ প্রাণ হারান৷ তাঁদের নাম যথাক্রমে সর্বশ্রী রফিক, বরকত, জববর, সালাম, রহমান৷ সেই আন্দোলনই  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের  নেতৃত্বে স্বাধীন বাঙলাদেশের আন্দোলনে রূপ পায়৷ তাঁর দলের নাম  হয় আওয়ামী লীগ৷ এই দল ঘটন হয় ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন৷ ১৯৪৮ সালে ২৩ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে মাননীয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেবার দাবী তোলেন ৷ সেটা নাকচ হয়৷ চরম আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে বাংলাভাষা পাকিস্তানের  অন্যতম রাষ্ট্রভাষার  স্বীকৃতি লাভ করে৷

১২ই সেপ্ঢেম্বর আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান দলকে নিয়ে কোয়ালিশনে মন্ত্রীসভা ঘটন করে৷ আতাউর রহমান  খান এর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার ঘটন হয়৷

১৯৬৬ সালে মুজিবর রহমানেরঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা৷ ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ স্বাধীন বাংলা দেশের পতাকা উত্তোলন হয়৷ বাংলাদেশে ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজিবুর রহমান বাংলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন৷ ১৯৭১, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে৷ ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারী সেখ মুজিবর রহমান ও ১১জন মন্ত্রী শপথ নেন৷

স্মরণে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পশ্চাতে  ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানকে স্বীকার করতে হয়৷ ইন্দিরা গান্ধী নানাভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে ছিলেন৷ স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি প্রথম স্বীকৃতি দেন৷ পাশাপাশি তৎকালীন রাশিয়ার সোবিয়েৎ সরকার ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন৷ পরে পৃথিবীর অন্যরাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের সরকারকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদা দান করেন৷ শেষের দিনে ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদাকে স্বীকার করেন৷

ইতিবৃত্তের নজিরে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘটন আর নেই৷ যা বাঙলাদেশ নজির সৃষ্টি করেছে৷ বাঙলাদেশের এই আন্দোলনকে ও ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে৷  শুধু তাই নয় এই বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসাবে ও স্বীকৃতি দান করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রসংঘ৷ এই বাংলা ভাষায় বর্তমানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লিখিত সঙ্গীত জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে ভারতে বাংলাদেশে ও শ্রীলঙ্কা  বা সিংহলে৷

মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় প্রভাতরঞ্জন সরকাব--- যিনি  ‘প্রাউট’ তত্ত্বের প্রবক্তা ও রেণেশাঁ ইয়ূনিবার্সালের প্রতিষ্ঠাতা৷ তিনি পাঁচ হাজার আঠেরটি সঙ্গীত রচনা করেন  যার কয়েকটি বাদে সবই বাংলায়৷ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে সেইগুলি মধুর বাংলা ভাষাতে গীত হয়৷ এছাড়া মধুর বাংলাভাষাতে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি,বাংলার লোকসঙ্গীত আরো অনেক গান বাংলাতে লেখা সেইগুলিও যুগ যুগ ধরে  সারা পৃথিবীতে সমাদৃত৷ তাই বর্তমানে মধুর বাংলাভাষার লিখিত বাংলা সঙ্গীত বিশ্বখ্যাত৷

মহামান্য রাষ্ট্রসংঘ সবকিছু বিবেচনা করেই ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেন৷ সত্যই এটি বাঙালী জনগোষ্ঠির কাছে অত্যন্ত গৌরবের৷ তবে অত্যন্ত দুঃখের ও বেদনার কথা এই ভারতেই কিন্তু আমাদের মহান মাতৃভাষা বাংলা ভাষা পদে পদে অবদমিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে৷ এই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার বাঙলার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে বাঙালীর মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ্ করছেন৷ পরিতাপের বিষয় রাজ্য সরকারও বাংলা ভাষাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না৷

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষা বাংলা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাকে প্রচারকরা ও বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে ব্যাপকভাবে  প্রচারের ব্যবস্থা করাটা রাজ্য সরকারের দায়িত্বের মধ্যে কি পড়ে না? ভাষার দমনটা জীবনের  সার্থক বিকাশকে রোধই করে৷ অন্যভাষা শিক্ষায় কোন দোষ নেই কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলাটা অপরাধ বিশেষ৷