আশির দশকে শীতের মরশুমে আনন্দনগরে আনন্দমার্গ হাইস্কুলে পাঠরত পুত্রকে দেখতে গিয়েছি, প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরার পালা, হোষ্টেলে সন্ধ্যার আহার সেরে দ্রুত পা চালিয়ে এসে হাওড়াগামী হাতিয়া প্যাসেঞ্জার ধরলাম৷ আরও কিছু যাত্রী ওই ট্রেনে উঠলেন, ট্রেন কিছুটা যাওয়ার পর সবে তন্দ্রা ধরেছে, হঠাৎ কানে এল---জানেন! আমি আনন্দমার্গকে পছন্দ করি না, কিন্তু এদের শিক্ষাব্যবস্থাটা ভাল, তাই ছেলেকে এখানে ভর্ত্তি করেছি, আর একজন বলছেন---আমি ৭৫ সালে এই এরিয়াতে পোষ্টিং ছিলাম (চাকুরী স্থল) তখন সরকারী নির্দেশে আনন্দমার্গের অনেক মহারাজকে এ্যারেষ্ট করেছি৷ কয়েকজনকে জেলেও পাঠিয়েছি তখন থেকেই এঁদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় এদের মধ্যে অনেক কিছু ভাল জিনিস দেখেছি৷ তাই শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আনন্দমার্গ স্কুলেই ভর্ত্তি করলাম এবং আনন্দনগরের আশ্রমিক পরিবেশে যাতে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে সেই প্রচেষ্টা নিয়েছি আরও কিছু কথোপকথন শ্রুতিগোচর হল যেমন---এখানকার সন্ন্যাসীদের ব্যবহার আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার, সর্বোপরি ছোট ছোট ছেলেদেরকে নিজ পুত্রবৎ স্নেহ করা, ভালবাসা---এগুলি সত্যই মনে রাখার মত, একজন বলছেন--- আমার পুত্রের যে পড়াশুনা হবে, সে আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু এখানে ভর্ত্তি করার পর দেখছি--- সে পড়াশুনা করছে এবং শুধু তাই নয়, গত পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে৷ এঁদের কথাবার্র্ত থেকে জানলাম---প্রথম ব্যক্তি একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং দ্বিতীয় জন হাওড়ায় বসবাসকারী এক দক্ষ পুলিশ অফিসার৷ ঐ সময় পত্র-পত্রিকায় কিছু গোষ্ঠী থেকে আনন্দমার্গ সম্পর্কে নানা মুখরোচক কুৎসা প্রচার করা হত ও কিছু মানুষ সেগুলি বিশ্বাস করতে বাধ্য হতেন৷ যাঁদের আনন্দমার্গের আদর্শ আনন্দমার্গ ও কার্যবলি সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানার সুযোগ হত, তাঁরাই আনন্দমার্গ স্কুলগুলিতে নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভর্তি করাতেন৷
এরকম একটি আবহমণ্ডলের মধ্যে পাঁশকুড়া থানার অন্তর্গত রঘুনাথবাড়িতে ১৯৮৫ সালের ১০ই জানুয়ারী একটি আনন্দমার্গ স্কুলের শুভ সূচনা হল৷ রঘুনাথবাড়ি রঘুনাথ জীউ অস্তলের মোহন্ত শ্রদ্ধেয় চতুর্ভুজানুজ দাসের অকৃপণ সহযোগিতায় ঠাকুরবাড়ির একটি কক্ষে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু, প্রথম শিক্ষক ছিলেন---আটবেড়িয়া গ্রামনিবাসী শ্রী নিখিল কুমার মাইতি৷ একটি অজানা অচেনা নূতন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজের সন্তানদের ভর্তি করে যিনি শিক্ষা বিস্তারের শুভ সূচনা করলেন ও সাহসিকতার পরিচয় দিলেন, তিনি হলেন সেক্ রেফায়েৎ হোসেন মল্লিক৷ তাঁর পুত্রদের একজন বর্তমানে কলেজে অধ্যাপনা কার্যে রত৷ কিছুদিন পর বিদ্যালয়টি শ্রী দুর্গাপদ মণ্ডলের বাড়ির দালানে স্থানান্তরিত হল৷ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানাভাব দেখা দিল, পরমপুরুষের কৃপায় ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যষ্টিগণের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের নিকটেই এক খণ্ড জমি সংগৃহীত হল৷ আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের বরিষ্ট সন্ন্যাসী আচার্য পূর্ণানন্দ অবধূতের সুপরামর্শে এবং ‘সাধন-পুতুল- অমিত এই ত্রয়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে একতলা একটি ভবন নির্মিত হল, মাত্র ৯টি ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা চারশত পঁয়ত্রিশ শিক্ষক সংখ্যা পনের অশিক্ষক কর্মচারী সাত জন৷ প্রায় দুইবিঘা জমির উপর বাউণ্ডারী দিয়ে ঘেরা এক সুন্দর পরিবেশের মধ্যে বিদ্যালয়ের পঠন কার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে চলেছে৷ বিদ্যালয়ের নিজস্ব দ্বিতল বাড়ি ও গাড়িও হয়েছে৷ এই বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপন করে বহু ছাত্র-ছাত্রা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ আবার কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা পাঠের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন৷ কর্মসূত্রে যাদের বাইরে যেতে হয়নি, তাদের অনেকেই নিজের ছেলেমেয়েদের এই বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেন৷ এই অবস্থা কিন্তু একদিনে হয়নি৷ অনেক ঝড়-ঝঞ্ছা,উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়টি ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে৷ বহুজনের সাহায্য সহযোগিতাকে পাথেয় করেই৷ তার তাই অগ্রগতি কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ বুদ্ধি দিয়ে শ্রম দিয়ে, কেউ বা সিমেন্ট-রড- বালি-বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, বিদ্যালয়ের ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের প্রাকমূহূর্তে এঁদের সবাইকে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা৷ যাঁদের ঐকান্তিক প্রয়াস ব্যতিরেকে আনন্দমার্গ স্কুলটি শুরু করা সম্ভব হত না, তাঁরা হলেন রঘুনাথবাড়ি রামতারক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক শ্রীমনিলাল মাইতি ও শ্রী অশ্রুকুমার মণ্ডল, সাধনা সেবা ও ত্যাগের মাধ্যমে তাঁদের সুদুর্লভ মনুষ্যজীবন সার্থক হোক এই কামনা করি৷
মানুষ,পশুপাখী, তরুলতা সবার কল্যানার্থে মহান দার্শনিক, ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (ভক্তদের কাছে তিনি আনন্দমূর্ত্তি নামে পরিচিত) আনন্দমার্গ সংঘটন তৈরী করেছেন, এই সংঘটনের অনেকগুলি শাখা আছে তাদের মধ্যে একটি হলEducation Relief & Welfare Section. আনন্দমার্গ স্কুলগুলি এই বিভাগের অন্তর্গত৷ পাঁশকুড়া ব্লকে ছটি আনন্দমার্গ স্কুল আছে৷ সুরানানকার আনন্দমার্গ স্কুলটি মহিলা পরিচালিত৷ বয়সের বিচারে রঘুনাথবাড়ি আনন্দমার্গ স্কুলটি দ্বিতীয়৷ তবে আয়তন পরিকাঠামো তথা পঠন পাঠনের উৎকর্ষতার বিচারে এটি সবার সেরা বলেই মনে হয়৷ যোগ্য পরিচালক মণ্ডলী এবং সুদক্ষ নীতিনিষ্ট শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে এই বিদ্যালয়টি একটি আদর্শ শিক্ষা নিকেতন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে আশা রাখি৷ বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেন শ্রী সঞ্জিত বাগ ও সভাপতি শ্রী রণজিৎ ভৌমিক৷ এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যাঁরা নিজেদের জীবন ধন্য করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই অন্তরের টানে বিদ্যালয়টির কথা ভাববেন ও প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন৷ প্রতিষ্ঠানটি এলাকার মানুষের ভালবাসা আগেও পেয়েছে, ভবিষ্যতেও পাবে, এভাবেই বিদ্যালয়টি একদিন মহামহীরুহে রূপান্তরিত হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই৷
- Log in to post comments