আত্মভোলা সাধক হওয়া সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ শুষ্ক জ্ঞান আর নীরস তত্ত্বের গাম্ভীর্যে নিজেকে আবৃত করে রাখেন নি৷ রসে বশে রাখিস মা৷ আমায় শুটকো সন্ন্যাসী করিস নে৷ এই ছিল তাঁর একান্ত আর্তি৷ জহুরী যেমন জহর চিনতে ভুল করে না, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণেরও লোকচরিত্র বুঝতে বিলম্ব হতো না৷ ভক্তরূপে কত লোকজন আসতো তাঁর কাছে৷ সবাই তো আর ভক্তির টানে আসতো না৷ অনেকে অনেক রকম স্বার্থ নিয়ে আসতো৷ সহজপথে পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষ নিয়ে আসতো৷ শ্রীরামকৃষ্ণ তাদের নিয়ে এমন পরিহাস করতেন যে উপস্থিত ভক্তরা হাসি সংবরণ করতে পারতেন না৷ নিছক ব্যঙ্গ বিদ্রূপই নয়, ওই রসিকতার মধ্য দিয়েই পরিচয় মিলতো তাঁর বাস্তববোধ, লোকচরিত্র বোঝার ক্ষমতা আর নির্ভীক স্বাধীন মানসিকতার৷ তথাকথিত অশিক্ষিত গেঁয়ো পূজারী হয়েও তৎকালীন মনীষীদের সাথেও তিনি যেরকম মার্জিত পরিশীলিত ও বুদ্ধিদীপ্ত তাৎক্ষণিক রঙ্গ রসিকতা করেছিলেন তাতে চমৎকৃত হতে হয়৷ আবার সহজ সরল রসিকতার মধ্য দিয়ে কত মূল্যবান উপদেশও তিনি দিয়েছেন৷
নরেন্দ্র তখন সবে দক্ষিণেশ্বরে আসতে শুরু করেছে৷ একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে বললেন, দ্যাখ, হাতি যখন চলে যায় পেছনে কত জানোয়ার কতরকম চীৎকার করে৷ কিন্তু হাতি ফিরেও চায় না৷ তোকে যদি নিন্দে করে তুই কি করবি?
নরেন্দ্র অমনি জবাব দিল, আমি মনে করবো কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে৷ শ্রীরামকৃষ্ণ অমনি বলে উঠলেন, নারে, অতো দূর নয়৷ ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন৷ তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে, মন্দলোকের কাছ থেকে তফাৎ থাকতে হয়৷ বাঘের ভেতরেও নারায়ণ আছে, তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না৷
বিশ্বাসের কত জোর সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন এক ভক্তকে বললেন রামচন্দ্র যিনি সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম তাঁর লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হলো৷ কিন্তু হনুমান রাম নামে বিশ্বাস করে লাফ দিয়ে সমুদ্রের পারে গিয়ে পড়লো৷ তার আর সেতুর দরকার হয়নি৷
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ রচয়িতা শ্রীম সবে রামকৃষ্ণের কাছে আসতে শুরু করেছেন৷ দ্বিতীয় দিন আসতেই শ্রীরামকৃষ্ণ উচ্চ হাস্যে নরেন আর অন্যান্য ভক্তদের বলে উঠলেন, ওই রে আবার এসেছে৷ দ্যাখ, একটা ময়ূরকে বেলা চারটের সময় আফিম খাইয়ে দিয়েছিল৷ তারপর দিন ঠিক চারটের সময় ময়ূরটা উপস্থিত---আফিমের মৌতাত ধরেছিল--- ঠিক সময়ে আফিম খেতে এসেছে৷
নরেন্দ্রের সাথে প্রথম পরিচয়ের পর শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন তাকে ডেকে বললেন, দ্যাখ, আরেকটু বেশি বেশি আসবি৷ সবে নতুন আসছিস কি না৷ প্রথম আলাপের পর নতুন সবাই ঘন ঘন আসে, যেমন নতুন জামাই৷
অতি গূঢ় তত্ত্ব বোঝাবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন সুন্দর সরস উপমা ব্যবহার করতেন তা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিত্যকার জীবনের উপকরণ থেকেই নেওয়া৷ কেশব সেনকে মহাকালী ও সৃষ্টি প্রকরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বললেন, যখন সৃষ্টি হয়নি, চন্দ্র সূর্য গ্রহণ পৃথিবী ছিল না, নিবিঢ় আঁধার, তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন৷ জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ সকল কুড়িয়ে রাখেন৷ গিন্নীর কাছে একটা ন্যাতাকাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নী পাঁচরকম জিনিস তুলে রাখে৷
শ্রীরামকৃষ্ণ আরো বললেন, মন যে রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছোপবে৷ যদি একটু ইংরেজি পড় তো অমনি মুখে ফুটফাট ইটমিট ইংরেজি কথা এসে পড়ে৷ আবার পায়ে বুট জুতো, শিস দিয়ে গান করা এইসব এসে জুটবে৷ আবার যদি পণ্ডিত সংস্কৃত পড়ে অমনি শ্লোক ঝাড়বে৷ যদি ভক্তের সঙ্গ কর তাহলে ঈশ্বর চিন্তা , হরি কথা এইসব হবে৷
প্রসাদী সঙ্গীতে আছে---‘এ সংসার ধোঁকার টাটি৷ শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, সংসারে ঈশ্বর লাভ হবে না কেন? জনক রাজার হয়েছিল৷ ঈশ্বরের করুণা লাভ করলেন---
এ সংসারই মজার কুটি
আমি খাই দাই আর মজা লুটি৷
জনক রাজা মহা তেজা
তার বা কিসের ছিল ত্রুটি৷
সে এদিক ওদিক দুদিক রেখে
খেয়েছিল দুধের বাটি৷
শ্রীরামকৃষ্ণ সাম্প্রদায়িক বা দলীয় ঝগড়া বিবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না৷ কেশব সেন আর বিজয় গোস্বামীর মধ্যে প্রায়ই ধর্ম নিয়ে বাক-বিতণ্ডা হতো৷ একদিন দুজনের উপস্থিতিতেই শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তোমাদের ঝগড়া-বিবাদ---যেমন শিব আর রামের যুদ্ধ৷ রামের গুরুশিব৷ যুদ্ধও হলো, দুজনে ভাবও হলো৷ কিন্তু শিবের ভূত-প্রেতগুলো আর রামের বানরগুলো ওদের ঝগড়া কিচিমিচি আর মোটে না৷
একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ জনাকয়েক ভক্ত সহ সিমুলিয়া ষ্ট্রীটের ভক্ত সুরেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে গেছেন৷ বাড়ির লোকেরা বসবার জন্য নীচের ঘর খুলেদিলেন৷ কিন্তু গাড়ি ভাড়া দেবে কে? সুরেন্দ্র মিত্র থাকলে তিনিই দিতেন৷ তখন ঠাকুর একজন ভক্তকে নীচুস্বরে বললেন, ভাড়াটা মেয়েদের কাছ থেকে চেয়ে নে না৷ ওদের ভাতার রা তো যায় আসে৷ তাকি ওরা জানে না?
সাধকদের সাধন-পথের সঙ্গীর দরকার হয়৷ ভাবের আদান-প্রদান সাধনালব্ধ জ্ঞান উপলব্ধি হৃদয়ের কথা কইবার মানুষ দরকার হয়৷ তাই শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বললেন, এই যে শিবনাথ, দ্যাখো তোমরা ভক্ত, তোমাদের দেখে বড় আনন্দ হয়৷ গাঁজাখোরের স্বভাব আর একজন গাঁজাখোরকে দেখলে ভারি খুশী হয়৷ হয়তো তার সঙ্গে কোলাকুলিই করে৷
দক্ষিণেশ্বরে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী আসতো৷ তাদের মধ্যে ভক্তের সংখ্যা ছিল খুবই কম৷ বেশির ভাগই বিষয়াসক্ত৷ উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে কী লাভ৷ তাই সেইসব ঘোর সংসারী লোকদের শ্রীরামকৃষ্ণ রাসমণির কালীমন্দির দেখিয়ে বলতেন, যাও, বেশ বিল্ডিং- দ্যাখো গে৷ একদিন তিনি ভক্তদের বললেন, সংসারী লোকদের যদি তারা কখনো শুনবে না৷ তাই বিষয়ী লোকদের টানবার জন্য গৌর নিতাই দুই ভাই মিলে পরামর্শ করে এই ব্যবস্থা করে ছিলেন---‘মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী মেয়ের কোল, বোল হরি বোল৷’ প্রথম দুটির লোভে অনেকে হরিবোল বলতে যেত৷ হরিনাম সুধার একটু আস্বাদ পেলে বুঝতে পারতো যে মাগুর মাছের ঝোল আর কিছুই নয়, হরিপ্রেমে যে অশ্রু পড়ে তাই৷ যুবতী মেয়ে কি না পৃথিবী৷ যুবতী মেয়ের কোল কি না--- ধুলায় হরিপ্রেমে গড়াগড়ি৷
সমাধি হলে সবকর্ম শেষ হয়ে যায়৷ জপতপ পূজা,অর্চনা বিষয় কর্ম-সব ত্যাগ হয়৷ প্রথম প্রথম কর্মের খুব হৈচৈ থাকে৷ যত ঈশ্বরের দিকে এগোবে ততই কর্মের আড়ম্বর কমে৷ এ-তত্ত্বই সরস উপমা সহযোগে শ্রীরামকৃষ্ণ বোঝালেন, যেমন ব্রাহ্মণে ভোজনে প্রথমে খুব হৈচৈ৷ যখন সকলে পাতা সম্মুখে করে বসলো, তখন অনেক হৈচৈ কমে গেল৷ কেবল লুচি আনো শব্দ হতে থাকে৷ তারপর যখন লুচি তরকারী খেতে আরম্ভ করে তখন বারো আনা শব্দ কমে গেছে৷ যখন দই এলো তখন সুপসুপ---শব্দ নেই বললেও হয়৷ খাবার পরনিদ্রা৷ তখন সব চুপ৷
সমাধি হবার পর শরীর থাকে না৷ শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, কারু কারু লোক শিক্ষার জন্য শরীর থাকে৷ যেমন চৈতন্যদেব৷ কূপ খোঁড়া হয়ে গেলে কেহ কেহ ঝুড়ি কোদাল বিদায় করে দেয়৷ কেউ কেউ রেখে দেয়৷ ভাবে যদি পাড়ার কারু দরকার হয়৷ এরূপ মহাপুরুষ জীবের দুঃখে কাতর৷ এরা স্বার্থপর নয় যে, আপনাদের জ্ঞান হলেই হলো৷ স্বার্থপর লোকের কথা তো জানো৷ এখানে মোত বললে মুতবে না, পাছে তোমার উপকার হয়৷
তীব্র বৈরাগ্য না আসলে ঈশ্বর লাভ হয় না৷ বদ্ধজীবের মন্দ বৈরাগ্যের উপমা দিতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বিজয় গোস্বামীকে এক মজার কথা শোণালেন, এক চাষী মাঠে জল আনতে গিয়েছিল৷ তার স্ত্রী যখন গিয়ে বললো, অনেক বেলা হয়েছে এখন এসো, এত বাড়াবাড়িতে কাজ নাই৷ তখন সে বেশি উচ্চবাচ্য না করে কোদাল রেখে স্ত্রীকে বললো, তুই যখন বলছিস তো চল৷
সুখ দুঃখ দেহ ধারণের ধর্ম৷ দেহ ধারণ করলেই সুখ দুঃখের ভোগ আছে৷ কর্মফল অখণ্ডনীয়৷ কথাটা সরস করে বোঝালেন শ্রীরামকৃষ্ণ৷ একজন কানা গঙ্গা স্নান করলে৷ পাপ সব ঘুচে গেল৷ কিন্তু কানা চোখ আর ঘুচলো না৷
মহিমাচরণ নামে শ্রীরামকৃষ্ণের একজন পণ্ডিতভক্ত ছিলেন৷ তিনি ভাল সংস্কৃত ও ইংরেজি জানতেন৷ সেই মহিমাচরণ একদিন দক্ষিণেশ্বরে আসতেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলে উঠলেন, একি! এখানে জাহাজ এসে উপস্থিত৷ এমন জায়গায় ডিঙ্গি-টিঙ্গি আসতে পারে, এযে একেবারে জাহাজ৷ তবে একটা কথা আছে---এটা আষাঢ় মাস৷
ব্রাহ্মসমাজের অনেক সভ্যই দক্ষিণেশ্বরে আনাগোনা করতেন৷ স্বয়ং কেশব সেনের সঙ্গেই তো যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের৷ তাঁর কাছে প্রতাপ মজুমদারও আসতেন৷ একদিন তিনি প্রতাপকে বললেন, দ্যাখো, তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের এক হরিসভায় আমায় নিয়ে গেছলো৷ আচার্য হয়ে ছিলেন একজন পণ্ডিত৷ নাম সামাধ্যায়ী৷ বলে কি ঈশ্বর নীরস৷ আমাদের প্রেমভক্তি দিয়ে তাঁকে সরস করে নিতে হয়৷ এইকথা শুনে আমি অবাক৷ তখন একটা গল্প মনে পড়লো৷ একটি ছেলে বলেছিল, আমার মামার বাড়িতে অনেক ঘোড়া আছে এক গোয়াল ঘোড়া৷ এমন গোয়াল যদি হয় তাহলে কখনো ঘোড়া থাকতে পারে না৷ গরু থাকাই সম্ভব৷ এরকম অসম্বদ্ধ কথা শুণলে লোকে কি ভাবে? এই ভাবে যে, ঘোড়া-টোড়া কিছুই নেই৷
- Log in to post comments