সাধারণতন্ত্র দিবসের সার্থকতা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়৷ এই সংবিধানে ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্ররূপে গড়ে তোলার

অঙ্গীকার করা হয়৷ এই সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছে, এখানে প্রতিটি মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ও সমান অধিকার ভোগ করবে৷ এখানে সমস্ত মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়৷ তাতে সমতার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার প্রভৃতি অধিকার দানের অঙ্গীকার করা হয়েছে৷  কিন্তু বাস্তবে নোতুন সংবিধান গ্রহণের ৭৩ বৎসর পরে আমরা কী দেখছি? সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার আজ কি ভারতের প্রতিটি নাগরিক ভোগ করতে পারছে? স্পষ্টতই না৷ কেন? আমরা দেখছি – মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি পরিবার সারা দেশের সম্পদ লুঠে পুটে খাচ্ছে, আর কোটি কোটি জনগণ অনাহারে, রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় কুঁকুড়ে মরছে৷

সাম্প্রতিক দুটি অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে ভারতে গত আর্থিক বছরে কোভিড মহামারীর সময়েও যখন দেশের নীচু তলার ২০শতাংশ মানুষের  উপার্জন ৫৩শতাংশ কমেছে তখন উপর দিকে ২০শতাংশ মানুষের আয় ৩৯ শতাংশ বেড়েছে৷ ৭৩তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ধনবৈষম্যের এই করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে দুটি আর্থিক সমীক্ষায়৷ এই ৭৩ বছর ধরে দেশের ধনী পুঁজিপতি গোষ্ঠী আরও ধনী হচ্ছে, কিন্তু গরীব মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷ যারা মাঠে মাঠে ধান ফলায়, তাদের পেটেই অন্ন নেই৷ যারা গায়ে গতরে খেটে একের পর এক বহুতল বাড়ী নির্মাণ করে চলেছে, সেই সব শ্রমিকদের নিজেদের

মাথা গুঁজবার জন্যে একটা ভাল ঘর নেই৷ তাদের অধিকাংশকেই ঝুপড়িতে বাস করতে হয়৷ যারা তুলা চাষ করছে ও বস্ত্রশিল্পে বস্ত্রের উৎপাদন করছে, তাদেরই ঠিকভাবে লজ্জা নিবারণের শীতের বস্ত্র নেই৷ একদিকে চরম অভাব অন্যদিকে বিলাসিতার স্রোত ও সম্পদের বেহিসাবী অপচয়

একদিকে মুষ্টিমেয় ধনকুবের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজপ্রাসাদে বিলাসিতায় জীবন যাপন করে তখন লক্ষ লক্ষ ধনীরা পাঁচতারা হোটেলের একটি ফ্ল্যাটের জন্যে একদিনেই ২০ হাজার টাকা অক্লেশে ব্যয় করে আনন্দ করে   যার পাশেই লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র মানুষের দৈনিক ২০ টাকাও জোটে না৷

স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ ৭৪ বছর পরও দেশের এই দুর্দশা কেন? কারণ, দেশ স্বাধীন হলেও সেই পুঁজিবাদী নীতিতেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে৷ ফলে ব্রিটিশ রাজত্বকালে শ্বেত পুঁজিপতিরা দেশের দরিদ্র মানুষদের শোষণ করত, স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ বেনিয়ার পরিবর্তে এ দেশেরই ‘বাদামী’ পুঁজিপতিরা দেশবাসীকে শোষণ করে চলেছে৷ আর যে সব রাজ্যে মার্কস্বাদীরা ক্ষমতায় এসেছিল বা এখনও আছে, তারাও পুরোপুরি পুঁজিবাদী নীতি নিয়েই দেশে পুরোপুরি পুঁজিবাদী শোষণকে অব্যহত রেখেছে ও মদত করেছে যেখানে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় ধনীদের হাতে৷ আর, তাছাড়া মার্কস্বাদও পুঁজিবাদেরই রকমফের৷ কারণ এখানেও অর্থনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে না, থাকে মুষ্টিমেয় প্রশাসক অর্থাৎ পার্টি কর্মীর হাতে৷ তাই মার্কস্বাদকে বলা হয় ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’৷

কিন্তু পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রেখে কিছুই লাভ হবে না৷ মূল নীতি যদি ভুল হয়, যতই কর্মদক্ষতা দেখানো হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সবই ভস্মে ঘি ঢ়ালার সামিল হবে৷

তাই চাই নোতুন আদর্শ, যা পুঁজিবাদ ও জড়বাদী মার্ক্সবাদের ত্রুটি থেকে মুক্ত৷ সেই নোতুন আদর্শের সন্ধান দিয়েছেন মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ যে আদর্শের নাম ‘প্রাউট’৷ ‘প্রাউট’ বলছে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প৷ ধনতন্ত্রে দেশের সম্পদ ক্রমশঃ কুক্ষিগত হতে থাকে ধনিক শ্রেণীর হাতে, আর মার্ক্সবাদে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে–তারাই হয়ে ওঠে ‘নয়া বুর্জোয়া শ্রেণী’৷ জনগণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে না, আর অর্থনৈতিক ক্ষমতার অভাবে শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে আর কোনো ক্ষমতাই থাকে না৷

তাই প্রাউট–প্রবক্তা বলেছেন, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে দিতে হবে৷ সবাইকে ‘ক্রয়ক্ষমতা’ দিতে হবে–নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যের ক্রয় করার সামর্থ্য দিতে হবে৷ স্থানীয় মানুষের হাতে থাকবে স্থানীয় অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষমতা৷ স্থানীয় অর্থনীতি–জমি বা কলকারখানার মালিকানা বা কৃষি–শিল্প–ব্যবসা–ব্ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ওপর বহিরাগত লুঠেরা পুঁজিপতিদের কোনো অধিকার থাকা চলবে না৷ তবেই জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা পাবে৷

আর তা করতে গেলে দেশের শাসকগোষ্ঠীকে পুঁজিবাদ বা মার্ক্সবাদের মোহ থেকে মুক্ত হতে হবে–নিঃস্বার্থ হতে হবে–‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাশীল হতে হবে৷ তা না হলে কেবল প্রতিশ্রুতি ও চমক সৃষ্টির বন্যা বইয়ে দিয়ে আখেরে জনগণের কোনো লাভ হবে না৷ জনগণকেও এই সত্য সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে ও সরকারকে এই পথে আসতে বাধ্য করতে হবে৷ তবেই সাধারণতন্ত্র দিবস সার্থক হবে৷