সামনে ‘ষোলোই ডিসেম্বর’---কী করবে বাংলাদেশ?

লেখক
সুকুমার রা

আর কযেকদিন পরেই ‘ষোলোই ডিসেম্বর’৷ বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা দিবস’৷ ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে ঘটা করে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের হাইকমিশন অফিসগুলোতে৷ এবারে বাংলাদেশ কী করবে? কেননা, গত জুলাই-আগষ্ট (২০২৪) মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এক অপ্রীতিকর ঘটনাকে বাংলাদেশের মৌলবাদী দল এবং সংস্থাগুলি এবং কেয়ারটেকার সরকার ‘পাঁচই আগষ্ট’কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ সেক্ষেত্রে কী ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে, নাকি ‘পাঁচই আগষ্ট’ গণভ্যুত্থানের দিনটি স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হবে? নাকি ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ প্রথম স্বাধীনতা দিবস, আর ’পাঁচই আগষ্ট’ দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে ?

এই কথাটি যত সহজভাবে বলা গেল, বাংলাদেশের জন্য কিন্তু তত সহজ নয়! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ‘ষোলোই ডিসেম্বর’-এর স্বাধীনতা দিবস আর দুই হাজার চবিবশের গণভ্যুত্থান পরবর্তী ‘পাঁচই আগষ্ট’কে একই পাল্লায় মাপলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিছুই বোঝেন না৷ বোঝেন যে না, তা তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন গণভ্যুত্থানের নামে যা যা করেছেন সেইসব দৃশ্যে এবং ডক্টর ইউনুসের মতো একজন মানুষকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান করে৷

ডক্টর ইউনুস মূলত পুঁজিবাদীদের পুতুল৷ মৌলবাদীরাও তাঁকে পুতুল করে কুর্শীতে বসিয়েছেন৷ উদ্দেশ্য বাংলাদেশের জাতীয় National) ভাবমূর্তিটাকে এই মুহূর্তে দেশের এবং বিশ্বজনমানসের কাছে অক্ষুন্ন রাখার কৌশল৷ কেননা,পুঁজিবাদীরা এবং মৌলবাদীরাও ভালো করেই জানেন বাঙালি জাতিসত্তার আসল রূপটি৷ বাঙালি জাতিসত্তার আসল রূপটি হলো চির বিদ্রোহী এবং চির অসাম্প্রদায়িক৷ যতই ইসলামী চাদর তাঁদের গায়ে পরানো হোক, বাঙালি জাতিসত্তাকে তাঁরা সহজে ভুলতে চায় না৷ তার প্রমাণ বাঙালি জাতি উনিশশো বাহান্ন খ্রীষ্টাব্দে দিয়েছে৷ উনিশশো একাত্তর খ্রীষ্টাব্দে দিয়েছে৷

উনিশশো সাতচল্লিশ খ্রীষ্টাব্দে ইসলামী চাদর গায়ে দিয়ে বঙ্গের একশ্রেণীর মুসলিম মৌলবাদী নেতারা ঐশ্লামিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ণে বিভর হয়ে পাকিস্থান রাষ্ট্রের অঙ্গরাষ্ট্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন৷ আর এই মৌলবাদকে ইন্ধন জুগিয়েছিল উপমহাদেশীয় পুঁজিবাদী শক্তি৷ পুঁজিবাদীদের চিরকালীন ভয় বাঙালি জাতির অমিত ত্যেজ এবং চির বিদ্রোহী সত্তাটাকে৷ আর তাই সিপাহী বিদ্রোহের সময়, সিপাহী বিদ্রোহ দমনের নাম করে এবং পরবর্তী সময় বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশীয় এবং দেশীয় পুঁজিবাদীরা মিলে বঙ্গদেশটাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ছেড়েছে৷ এই খণ্ডিত করণে স্বাধীন বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বাঙালি অধুসিত সকল বাঙালিস্থানের মানুষই যন্ত্রণার শিকার৷ ভারত রাষ্ট্রের বাঙালিস্থানের যন্ত্রণাক্লিষ্ট বাঙালির কথা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ কতটা জানেন জানি না৷ তবে একথা স্পষ্ট করেই বলা যায়, ভারত রাষ্ট্রের বাঙালিস্থানের বাঙালিরা ভালো নেই৷ তাঁদের ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ নেই, ’পাঁচই আগষ্ট’ নেই আছে বঞ্চনার ইতিহাস বহনকারী ’পনেরই আগষ্ট’৷ ভারত রাষ্ট্রের বাঙালিস্থানের বাঙালিরা ’পনেরই আগষ্ট’ গায়, ---

‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ

বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ৷

তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,

গাহে তব জয়গাথা৷

জনগণ মঙ্গলদায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা!’

কিন্তু বঙ্গের বাঙালিদের সে ভাগ্য মন্দভাগ্য! খণ্ডিত বঙ্গের বিভিন্ন বঙ্গে প্রতিমুহূর্তে বাঙালিদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে বাঁচতে হচ্ছে৷ এই হলো ভারত রাষ্ট্রের খণ্ডিত বঙ্গের বাঙালিদের অবস্থা৷

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালনের কথা বলতে গিয়ে এসব কথা নাই বা বললাম! বাংলাদেশের কথাই বলি৷ আসলে বাঙালি তো! রক্তে চিরকালীন বিদ্রোহী আর অসাম্প্রদায়িক সত্তা কাজ করে! আর সেই সত্তা থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের ’ষোলোই ডিসেম্বর’-এর দিনটির কথা মনে পড়ে৷ একাত্তরের নয়মাসের যুদ্ধ যাঁরা দেখেননি, নয়মাস যুদ্ধ শেষে ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ যাঁরা দেখাননি তাঁরাই ’পাঁচই আগষ্ট’কে স্বাধীনতা দিবস বলতে পারবেন৷ কিংবা বলা যায় ‘পাঁচই আগষ্ট’কে যাঁরা বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস বলছেন, তাঁরা একাত্তরের বিরোধী সত্তা৷ তাঁদের বাঙালি জাতিসত্তার চরিত্র কলুষিত৷ তাঁরা ভুলে গেছেন তাঁরা বাঙালি!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ৷ আর চবিবশের গণ অভ্যত্থান ইসলামী মৌলবাদের উত্থান৷ মূর্তি যাদের শত্রু৷ এই অভ্যাত্থানে চির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বাংলাদেশ আগামী কয়েক দশক কঠোরভাবে ইসলামী অনুশাসনের দিকে ধাবিত হবে৷ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামী মৌলবাদ বাড়বে৷ তবে আশার কথা এই, যেহেতু বাঙালি জাতি চির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের, সেইহেতু বাঙালির ভেতরের বাঙালি জাতিসত্তা মৌলবাদী ফতোয়া বেশিদিন মানতে পারবে না৷ কালো বোরখায় বেশিদিন নিজেদের ঢেকে রাখতে পারবে না৷ তখন তাঁরা বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির মুক্ত বাতাস নিতে বেরিয়ে আসতে চাইবেন৷ আর এই চাওয়া নোতুন আরেক বিক্ষোভের সূচনা করবে৷ সেটা যদি ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’-এর মতো কোনো উন্নত দর্শনের আলোকে হয় তাহলেই ভালো৷ আমার বিশ্বাস মৌলবাদে অতিষ্ট বাংলাদেশের মানুষ সে পথেই এগোবেন৷ আর প্রতিটি ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ সেই এগোবার শপথের দিন৷ এবার বাংলাদেশে যদি সেই ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ স্বাধীনতা দিবস পালিত না হয়, তাহলে বুঝবো, পুঁজিবাদ আর মৌলবাদের বিষ বাস্পে বাঙালি জাতিসত্তাটাই পচে গেছে !