‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বাঙালীদের কাছে প্রহসন মাত্র

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালী জনগোষ্ঠীর কাছে এখনো পৌঁছোয় নি৷ হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন৷ স্বাধীনতা মানে কি শুধু মাত্র ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করাতেই ক্ষান্ত থাকা? স্বাধীনতা কি জিনিস বাঙালী জনগোষ্ঠী এখনো জানেনা, আসলে জানানো হয়নি৷ চাক্ষুষ আমরা যে স্বাধীনতা দেখি আসলে সেটি শুধুই রাজনৈতিক গণতন্ত্র, সামাজিক ও সর্র্বেপরি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র সম্পূর্ণ উপেক্ষিত৷ অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কি জিনিস, খায় নাকি মাথায় দেয়? সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন ধারনা নেই৷ ভারতবাসীকে ‘প্রজা’ থেকে নাগরিককে উত্তীর্ণ হতে হবে৷ প্রজার কাছে রাজার নির্দেশই আইন, নাগরিককে তার অধিকার বুঝে নিতে হবে৷

ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করবার যে অধিকার ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র’ আমাদের দিয়েছে, সেই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিয়ে আমরা আমাদের মৌলিক অধিকারের (খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান) নিশ্চিতা পাই না৷ ঘরে ঘরে চরম অর্থনৈতিক সমস্যা, চরম বেকারত্ব, শিক্ষিত বেকার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি অথচ জনগণের উপার্জন নিম্নমুখী, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে৷ তার উপর জীবনদায়ী ওষুধ, মুড়ি, চিঁড়ের মতন অত্যাবশক পণ্যের ওপর জি এস টি চাপানো যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা৷

সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালী আজও পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারী তো বটেই, সরকারী দফতরেও বাংলা ভাষায় পরিষেবা পায় না৷ এমন এক পরিবেশ ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের ফেলে দেওয়া হয়েছে যেখানে বাংলাতে কথা বললে , স্বাক্ষর করলে নিম্নশ্রেণী,অশিক্ষিত, গাঙিয়া ইত্যাদি অপমানজনক ট্যাগ সেঁটে দেওয়া হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় চাকরীর নিয়োগ পরীক্ষা গুলিতে হিন্দীভাষীরা তাদের ভাষা হিন্দীতে দিতে পারছে , সংবিধানে বাঙালী তার মাতৃভাষা বাংলাতে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বাঙালী তা পারছেনা৷ অনুরূপ ভাবে ব্যাঙ্ক,রেল,বিমানবন্দরের মতন কেন্দ্রীয় দফতর গুলোতেও বাংলা ভাষাকে সংকুচিত করবার অনবরত চেষ্টা বিদ্যমান৷ রাষ্ট্রীয় ভাবে সহজেই বাঙালীদের ঘুসপেটিয়া, বিদেশী,বাংলাদেশী তকমা দিয়ে চুড়ান্ত অপমান,হয়রানি চলছে অহরহ৷ অথচ ভারতের স্বাধীনতার মুক্তি সংগ্রামে সবচেয়ে বেশী নিঃস্বার্থ ভাবে জীবন বিলিয়েছে বাঙালী জনগোষ্ঠী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বাঙলা মায়ের দামাল সন্তান-সন্ততিরা হাসতে হাসতে ফাঁসি কাষ্ঠে আত্মবলিদান করেছে৷ ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ, প্রফুল্ল চাকী, অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষ বসু সহ শত শত বাঙালী বিপ্লবীদের অবদান কারও অজানা নয়৷ তবে বর্তমানে সেই ইতিহাস বাঙালী ছাত্র, যুবদের কাছে সেভাবে উপস্থাপিত না করে সুপরিকল্পিত ভাবে ভুলিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তও পরিদৃশ্যমান৷ আজ ভারত ভূমিতে বাঙালীদের ‘বিদেশী’ আখ্যা নিয়ে বেঁচে থাকা আসলেই ক্ষুদিরাম বসুর অপমান, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সহ শত সহস্র আত্মবলিদানকারী বাঙালী বিপ্লবীদের অপমান৷ স্বাধীনতার তরে বাঙলা ও পঞ্জাবকে দ্বিখন্ডিত হতে হয়ছিল৷ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা প্রত্যেকটি পঞ্জাবী পুনর্বাসন পেয়েছে, জন প্রতি তাদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার৷ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আগত বাঙালী শরনার্থীরা আজও ভূমিহীন, চরম লাঞ্ছনা, সামাজিক নিষ্পেশনে, চরম বেদনায় অতিবাহিত হচ্ছে সেই নির্র্দেষ, নিরুপায় বাঙালীদের জীবন৷ বাঙালী বিদ্বেষী সরকার উদ্বাস্তু বাঙালীদের নূন্যতম সাহায্য করেনি বরং তাদের নিয়ে রাজনৈতিক চাল চালিয়েছে৷ বাঙালীদের উপর চলছে তীব্র মানস-অর্থনৈতিক শোষণ৷ রাষ্ট্র প্রচার যন্ত্রকে ব্যবহার করে বাঙালীদের মধ্যে হিন্দী ‘রাষ্ট্রভাষা’ বলে অপপ্রচার করছে৷ সর্বভারতীয় নিয়োগ পরীক্ষা গুলোকে জোর করে হিন্দী ভাষায় নেওয়া হচ্ছে অথচ ভারতের সংবিধান স্বীকৃত সরকারী ভাষাগুলির মধ্যে ‘বাংলা ভাষাও’ রয়েছে৷ সুচতুর ভাবে, রাষ্ট্রীয় শক্তির মদতে হিন্দী আগ্রাসনের চিত্র ফুটে উঠছে সর্বত্র---সঙ্গীত, সিনেমা,সাহিত্যে প্রভৃতিতে৷ বাঙলার সাহিত্য ভান্ডার ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের৷ সঙ্গীত, সিনেমার মতন সব বিনোদনের প্রদর্শনীগুলিও ছিল উন্নত লোক শিক্ষামূলক৷ বর্তমানে বাঙলার উন্নত মনষ্কাকে ধবংস করবার জন্য ল্যারালাপ্পা মার্কা অনুন্নত তো বটেই, অসংস্কৃতি মূলক সিনেমা,সঙ্গীত, সাহিত্যের প্রচারের মধ্যে দিয়ে বাঙালী সমাজের নিজস্ব চিন্তাধারা,বৌদ্ধিক শক্তিকে কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে --- তাই তো বলি প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ বাঙালী এখনো জানেনা, এখন যে ‘স্বাধীনতা’ দেখছে তা আসলেই প্রহসন৷

এমতবস্থায় আমাদের করণীয়--- সচেতনতা অর্জন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার বুঝে নেওয়া৷ স্বাধীন ভারতের মাটিতে বাঙালী জনগোষ্ঠীকে তার আর্থ-সামাজিক অধিকার তথা স্বাধিকার অর্জিত করার মধ্যে দিয়েই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সামাজিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাস্তবায়নের স্বপ্ণ সার্থক হবে, ভারতবর্ষ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করবে৷ মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রণীত ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ তথা প্রাউট দর্শনের নির্দেশাবলি প্রয়োগ করে কাঁচামালকে কেন্দ্র করে সামবায়িক ভিত্তিতে শিল্প কারখানা গঠন করা, অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ করতে স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ মুক্ত করা৷ ব্লক ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান করে তথা স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে৷ অপর দিকে বাঙালীকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার, পরনির্ভরশীলতা ভুলে বাঙালী তার নিজের উন্নত ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আচার, আচারনকে প্রাধান্য দিয়েই বাঙালীর নিজস্বতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই সামাজিক গণতন্ত্র ও সূচিত হবে৷ আসুন সব হীনমন্যতা ভুলে, ভয় ভুলে, রাজনৈতিক,ধর্মমতীয় দলাদলি ভুলে বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিই৷