সহজ নৈতিকতায় যেখানে বিচারের সমর্থন এসে গেল, তখন সেটা হয়ে গেল আধ্যাত্মিক নৈতিকতা (spiritual morality)৷ যেখানে জ্ঞান–ৰুদ্ধির স্ফূরণ হতে থাকে, সেই অনুযায়ী আধ্যাত্মিক নৈতিকতা আর অনৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য এসে যায়৷ এইজন্যে যদিও আধ্যাত্মিক নৈতিকতা সহজ নৈতিকতার মতই সাপেক্ষিক কিন্তু আধ্যাত্মিক নৈতিকতার মধ্যে বাহাদুরী আছে৷ এই বাহাদুরী বা বিশেষত্ব কী এটা স্থূল জগতের সঙ্গে পরমাত্মাকে সম্পর্কিত করে, সম্বন্ধিত করে৷ এটাই হচ্ছে এর বিশেষত্ব৷ যেরকম, মানসলোকে মনের ভাব আর পরমাত্মার ভাব, এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করার যে কলা তাকেই আমরা সাহিত্যের ভাষায় মিষ্টিসিজম্ বলি৷ হিন্দীতে একে বলা হয় রহস্যবাদ৷ রহস্যবাদ না বলে মিষ্টিসিজম্ বলা সঙ্গত৷ ঠিক এইরকম নৈতিকতার মধ্যে মিষ্টিকবাদকে দেখাটাই হবে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা৷ মিষ্টিকবাদের মধ্যে রসাস্বাদনের যা আনন্দ পাওয়া যায়, সহজ নৈতিকতাতেও সেই রকমই আনন্দ পাওয়া যায়৷ আবার সহজ নৈতিকতায় যে আনন্দ আছে আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় তার থেকে অধিক আনন্দ আছে৷
মিষ্টিকবাদ বা আধ্যাত্মিক নীতিবাদ কী সসীম জগতের সঙ্গে অসীম পরমাত্মার যে সম্পর্ক আছে তা পাওয়ার যে প্রচেষ্টা, আর সেই প্রচেষ্টা যখন ফলবতী হয় তখন মানুষ পরমাত্মার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷
মিষ্টিকবাদ কী এটা হচ্ছে সসীম আর অসীমের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনের নিরন্তর প্রয়াস৷
আধ্যাত্মিক নৈতিকতাতে আরও বিশেষত্ব আছে৷ এক বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, মানুষ এর দ্বারা পরমাত্মার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাবে আর দ্বিতীয় বিশেষত্ব হচ্ছে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা অনুসারে মানুষ যে কর্ম করবে তার ফলশ্রুতি হবে পুণ্য৷ এর অর্থ সাধনা মার্গে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা অনুযায়ী কর্ম করলে মানুষের ঊর্ধ্বগতিও হয়, আর সেই সঙ্গে পুণ্যার্জনও হয়৷ কিন্তু সহজ নৈতিকতা অনুযায়ী কর্মে পুণ্যার্জন হয় না৷ তুমি সত্য কথা বল, এতে বাহাদুরীটা কী তুমি ঘুষ নাও না, এতেই বা বাহাদুরী কোথায় এতে পুণ্যার্জনই বা কী হবে কিন্তু আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় তুমি সত্য কথাও বলছ আর অন্যের কল্যাণও করছ৷ তুমি ঘুষ নাও না, এতে কোনো পুণ্য নেই কিন্তু তুমি দান করছ৷ এটা হ’ল আধ্যাত্মিক নৈতিকতা৷ আধ্যাত্মিক নৈতিকতার দ্বারা পুণ্যলাভ হয়৷ আর এতে সবচেয়ে বড় লাভ কী পরমাত্মার সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায়৷
মানুষ যতখানি পুণ্যার্জন করবে ততখানিই অধিক জাগতিক সুখ পাবে৷ যত অধিক জাগতিক সুখ পাবে, সাধক তখন কী করবে সে বলবে, ‘‘হে পরমাত্মা! আমি আমার সমস্ত কর্মফল, পুণ্যফল, পুণ্য থেকে প্রাপ্ত সুখ চাই না৷ সেগুলো তুমি নিয়ে নাও৷ আধ্যাত্মিক নৈতিকতার কারণে যা কিছু শুভ সংস্কার আমি পেয়েছি তাও আমি চাই না৷ কেন তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়৷ তুমি এই সবকে নিয়ে নাও৷’’ এতে হবে কী পরমাত্মাকে সুখ দেওয়ার জন্যে মানুষ যখন কাজ করবে তখন অতি শীঘ্র তার আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়ে যাবে৷ এইজন্যে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা মানুষকে এগিয়ে চলতে অনেক সাহায্য করবে৷
তোমরা এটাও মনে রাখবে যে, নৈতিকতা অনুসারে তো অবশ্যই চলবে কিন্তু আধ্যাত্মিক নৈতিকতাকেও গ্রহণ করে নিতে হবে৷ এছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই৷ আর, চরম তথা পরম কথাটা হ’ল এই যে, আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় যে সুখ পাওয়া গেল তা যদি নিজের কাছে রেখে দিলে, তাহলে মন পরমাত্মা থেকে দূরে সরে যাবে৷ আর যদি তা পরমাত্মাকে দিয়ে দিলে তাতে এক লাভ আছে৷ সেটা কী জান কেউ নিজের শ্রদ্ধার সঙ্গে পরমাত্মাকে যা কিছুই দেয়, পরমাত্মা তা গ্রহণ করে নেন৷ এটা তাঁর স্বভাব৷ নেওয়াটা তাঁর কর্তব্য৷ তিনি এটা বলতে পারেন না অমুক মূর্খ, চণ্ডাল, তার দেওয়া কোনো জিনিস নোব না, কেননা এরা সকলেই তাঁরই সন্তান৷ তুমি যখন নিজের আধ্যাত্মিক প্রগতির শুভ ফল, শুভ সংস্কার পরমাত্মাকে দিয়ে দেবে তখন পরমাত্মাকেও তোমার কাছে আসতেই হবে৷ তুমি যেখান থেকেই দাও না কেন, তাঁকে আসতে হবে৷ নেবার জন্যে যখন তিনি উপস্থিত হবেন তখন কী হবে তুমি তাঁর সংস্পর্শে এসে গেলে৷ শুভ সংস্কার দিয়ে দিলে আর তার পরিবর্তে পেলে কী তাঁর নিকটে চলে এলে৷ তাই যে ৰুদ্ধিমান, সে পরমাত্মাকে নিকটে পাওয়ার জন্যে নিজের শুভ সংস্কার তাঁকে দিয়ে দেবে আর এগিয়ে যেতে থাকবে৷
এইসব করবার সময় সবচেয়ে বড় কথাটা মনে রাখবে যে, তুমি যে মানুষ রূপে পৃথিবীতে এসেছ এর পিছনে কোনো মিশন আছে, উদ্দেশ্য আছে৷ মিশন বা উদ্দেশ্য তোমার জানা থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে৷ কিন্তু মিশন যিনি তৈরী করেছেন তিনি সর্বদা তোমার সঙ্গে আছেন৷ হতে পারে তুমি তাঁকে দেখতে পারছ, এও হতে পারে যে তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ না৷ হতে পারে তুমি ৰুঝতে পারছ, আবার এও হতে পারে তুমি এটা বুঝতে পারছ না, কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, পরমপুরুষ তথা পরমাত্মা সর্বদা তোমার সঙ্গে আছেন৷ এই জন্যে এই যে সহজ নৈতিকতা, এই যে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা, এর যখন প্রতিপালন করে চলবে, তখন হতে পারে বিভিন্ন মানুষ, পাপী তোমার বিরুদ্ধাচারণ করবে, তবুও এই সবে ভয় পাবার কিছু নেই৷ বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডের যিনি সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ, যাঁর শক্তিতে অন্যে শক্তিমান, তিনি তো সর্বদা তোমার সঙ্গে আছেন৷ তুমি কেন ভয় পাবে! কাকে ভয় পাবে!