সঙ্গীত ও মাইক্রোবাইটাম

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ  ভৌমিক

সঙ্গীতের অভিস্ফুরন ঘটে বিশুদ্ধ চক্র হ’তে৷ এই চক্র আকাশতত্ত্বকে বা বোমতত্ত্বকে অর্থাৎ বাক্‌যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ আমরা জানি যে, ‘ভাব’ ভাষায় রূপান্তরিত হ’য়ে বাকযন্ত্রের মাধ্যমে বাকস্ফুরন বা শ্রুতিগোচরা হয়৷ এই শ্রুতিগোচরা আবাজই হ’ল ধবনি sound) এই বিশুদ্ধচক্রে আছে ১৬টি বৃত্তি৷ এদের মধ্যে ধবনি সংক্রান্ত বৃত্তি হ’ল ৭টি৷ এই ৭টি বৃত্তি হ’ল (১) ষড়জ, (২) ঋষভ (৩) গান্ধার (৪) মধ্যম (৫) পঞ্চম (৬) ধৈবত (৭) নিষাদ৷ এই সাতটি বৃত্তি সাতটি পশুপক্ষীর নিজস্ব ধবনি৷ যত সঙ্গীত তৈরী হয়েছে সব সঙ্গীতের মূল সুর সপ্তক (সা,রে,গা,মা,পা,ধা,নি)৷ এই সুর সপ্তক Permutation) ও Combination) হ’য়ে নানান ধরণের রাগ, রাগিনীর সৃষ্টি হয়েছে৷

বোমতত্ত্বের তন্মাত্র হ’ল ‘শব্দ’ বা ‘ধবনি’৷ পঞ্চ তন্মাত্রের মধ্যে শব্দ তন্মাত্রই হ’ল সব চাইতে সূক্ষ্ম তন্মাত্র৷ কারণ এই আকাশ তত্ত্বে রয়েছে কেবল মাত্র একটি তন্মাত্র৷ পজিটিভ মাইক্রোবাইটামের স্বভাব অনুযায়ী, এই সুক্ষ্ম ‘শব্দ’ তন্মাত্র হ’ল পজিটিভ মাইক্রোবাইম্‌ থাকার জন্যে সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ৷ তাই পজিটিভ মাইক্রোবাইটাম শব্দ মাধ্যমে স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করতে পারে অর্থাৎ এদের কাজ ক’রে যেতে পারে৷ কিন্তু সব শব্দই পজিটিভ মাইক্রোবাইটামের পক্ষে অনুকুল পরিবেশ নয়৷ কোন ধরনের শব্দ তন্মাত্র পজিটিভ মাইক্রোবাইটামের অনুকূল পরিবেশ হবে, তার প্রসঙ্গে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বে বলেছেন---

‘‘রক্তি, অনুরক্তি ও আসক্তির ভাবানুযায়ী মাইক্রোবাইটামের ধনাত্মিকা বা ঋণাত্মিকা গতি নির্ধারিত হয়৷ স্থূলতম তন্মাত্র গন্ধ যদি সূক্ষ্ম ভাবানুযায়ী হয় তবে তা ধনাত্মক মাইক্রোবাইটামের উত্তম বাহক৷ যদি তা জড় ভাবাত্মক হয় তবে তা শেষ পর্যন্ত Negative Microvitum) তৈরী করে দেবে৷ শব্দ তন্মাত্র যদি হয় ‘র‌্যা-র‌্যা-র‌্যা---ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা---’ অথবা ‘‘তুমি গান গাও আমি তবলা বাজাই/নেচে নেচে নরকের পানে ধাই’’---এও শব্দ তন্মাত্র কিন্তু জড়ানুশয়ী৷ তাই শব্দ তন্মাত্র হলেই যে ধনাত্মক মাইক্রোবাইটামের উত্তম বাহক তা নয়, আবার গন্ধ তন্মাত্র হলেই যে তা ঋনাত্মক মাইক্রোবাইটামের উত্তম বাহক এমন কথাও হলফ করে বলা যায় না৷ তাই বুদ্ধিমান মানুষের উচিত সূক্ষ্মানুশয়ী তন্মাত্র গ্রহণ করা ও স্থূলানুশয়ী তন্মাত্র বর্জন করা৷’’

মাইক্রোবাইটাম পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ যাইহোক না কেন, মাইক্রোবাইটাম অতি সূক্ষ্মসত্তা৷ মাইক্রোবাইটাম অতি সূক্ষ্ম সত্তা৷ মাইক্রোবাইটাম যেহেতু সুক্ষ্মসত্তা সেহেতু এরা তন্মাত্রের মধ্য দিয়ে সহজে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে৷ তাই সঙ্গীত যত সূক্ষ্মভাশয়ী হবে ততই তা পজিটিভ মাইক্রোবাইটার উত্তম বাহক হবে, আর যদি শব্দ তন্মাত্র জড়াশয়ী হয় তবে তা নেগেটিভ মাইক্রোবাইটামের উত্তম ধারক ও বাহক হয়ে উঠবে৷ আমাদের প্রভাত সঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে অজস্র সূক্ষ্মভাবাশয়ী গান৷ আমরা যদি ছন্দ-তাল ঠিক রেখে নিষ্ঠা ও ভাবের সঙ্গে গান গাইতে পারি তাহলে ঐ গানের তরঙ্গের যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে তাতে অবশ্যই পজিটিভ মাইক্রোবাইটামের সমাবেশ ঘটবে৷ আর এই পজিটিভ মাইক্রোবাইটাম মানুষের জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনস্তরেই প্রগতি ও কল্যাণ ডেকে আনবে৷

শ্রী পি.আর.সরকার এ সম্পর্কে আরও বলেছেন---সূক্ষ্মভাবাশয়ী কোন গানের আসরে ‘গন্ধর্ব’ নামক দেবযোনী মাইক্রোবাইটামের কখনও কখনও আগমন ঘটে ও সঙ্গীত শিল্পীকে সঙ্গীতের সূক্ষ্মস্তরে চরম উন্নতিতে সাহায্য করে৷ এই ‘গন্ধর্ব’ মাইক্রোবাইটামেরা অশরিরী অবস্থায় ঘুরতে থাকে৷ অবশেষে এই গন্ধর্ব-মাইক্রোবাইটাম সূক্ষ্মভাবাশয়ী কোন সঙ্গীত আসরে কিংবা হরিপরিমণ্ডলে আশ্রয় নেয় ও শিল্পীর কন্ঠকে আরও সুললিত ক’রে সঙ্গীত শিল্পীকে প্রভূত সাহায্য করে৷ এই কারণেই সাধনার পূর্বে গানের চর্চ্চ করে নেওয়া হয়৷

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে গার্লস্ প্রাউটিষ্টের আহ্বান

বিশ্বসমাজের প্রায় অর্দ্ধেক হলো পুরুষ, অর্দ্ধেক নারী৷ সমাজে তাদের অস্তিত্বটা যেন একই উড়ন্ত বলাকার দুটি ডানা৷ একের দুর্বলতায় অন্যেও দুর্বল হয়ে পড়ে, একের বিফলতায় অন্যেও মুখ থুবড়ে পড়ে৷ তাই, পুরুষদের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যদি নারীদেরও বিকাশ ও প্রগতি না ঘটে তবে সমাজও তার গতি হারিয়ে ফেলতে বাধ্য৷ কিন্তু আজ নারীকে চিহ্ণিত করে রাখা হয়েছে শুধু পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসাবে৷ আজ বাঙলা, ভারত তথা বিশ্বের অনুন্নত, উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশগুলিতে সর্বত্রই নানাপ্রকারে নারী–নির্যাতন ও শোষণ ঘটে চলেছে৷ উৎপীড়িত ও বঞ্চিত নারীসমাজ আজ নিজেদের স্বাধীনতা, স্বাধিকার, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, শিক্ষা ও সমানাধিকার ইত্যাদির দাবীতে পৃথিবীর দেশে দেশে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন গড়ে তোলার পথে এগিয়ে চলেছে৷

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে আশ্রয় করেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে পুষ্ট হয়ে আজকের প্রায় সমস্ত নারী সংঘটন কাজ করছে৷ বৃহত্তর আদর্শ সমাজ তৈরীর দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে–বিশ্ব নারী সমাজের সংহতি ও শোষণ মুক্তির চিন্তা নিয়ে কোনও নারী সংঘটন নেই বললেই চলে৷ তাই নারীর প্রতি অন্যায় অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনও অনেক সময় রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারে পরিণত হয়৷

বিশ্ব নারী সমাজকে সামাজিক–র্থনৈতিক– ও ধর্মমতের সংকীর্ণতা থেকে উদ্ধার করে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার মহত্তর উদ্দেশ্য নিয়েই ‘‘গার্লস্ প্রাউটিষ্ট’’ সংঘটনের সৃষ্টি৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের পূর্ণাঙ্গ সমাজ দর্শন–‘প্রাউট’ অনুসারে ‘‘গার্লস্ প্রাউটিষ্ট’’ চায় বিশ্বের নারীসমাজের সার্বিক সমস্যা ও শোষণ থেকে মুক্তি৷ তাই আজ গার্লস্ প্রাউটিষ্ট আঞ্চলিক স্তর থেকে বিশ্বভিত্তিক মহিলা সমাজ তৈরী করে বাস্তব কর্মসূচী নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে৷

প্রতিটি সমস্যার মূল উৎস মানুষের ভোগবাদী মানসিকতা৷ এই মানসিক ব্যাধিই বিশ্বসমাজ–মনকে বিকৃত করেছে যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী নারীসমাজের ওপর শোষণ জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে৷ পণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবা–নারীর সমস্যা, পতিতাদের পুনর্বাসন সমস্যা, দেবদাসীদের কুসংস্করাচ্ছন্ন জীবনের হাহাকার, নারীদের শ্লীলতাহানি হবার সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষিত নারীদের বেকারত্ব, কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যা, আজ সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এই সব অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা সমাজ–মনকে আদর্শায়িত করতে প্রাউট নির্দেশিত সমসমাজ তত্ত্বই নারী ও পুরুষের মধ্যে সমত্ববোধ এনে দেবে৷ বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনে সার্বিক বিকাশের পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদে পৌঁছানোর প্রয়াসই হ’ল মানজীবনের যথার্থ প্রগতিশীলতা৷ তাই প্রাউটের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘গার্লস্ প্রাউটিষ্ট’ আদর্শ সমাজ নির্মাণে তথা নারী সমাজের সামগ্রিক সমস্যা সমাধানের মহান্ ব্রত নিয়ে কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷

বিশ্বের নারী সমাজের সার্বিক শোষণ মুক্তির পথ হ’ল ‘প্রাউট’৷ গার্ল প্রাউটিষ্ট শোষণ মুক্তির অভ্রান্ত পথ প্রদর্শক৷ বাঙলা, ভারত তথা বিশ্বের সমস্ত নারী সমাজের কাছে আমাদের আহ্বান–আসুন, এই মুহূর্ত থেকেই আমরা শোষণমুক্তির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি ও নিপীড়িত মানবাত্মার নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ‘প্রাউটে’–র (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) বাস্তবায়নে প্রতিটি সৎ নীতিবাদী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করি৷