শ্রাবণী পূর্ণিমা–আত্মজ্যোতিতে প্রতিষ্ঠিত হও

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’–আত্মার মুক্তি ও জগতের কল্যাণ–এই মহান আদর্শকে সামনে রেখে আনন্দমার্গ প্রচারক সঙঘ তার শাখা–প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের দেশে–দেশে৷ ধর্ম ও কর্মের সমন্বয়ে এই সুমহান আদর্শকে রূপ দিতে আনন্দমার্গ গড়ে তুলেছে বিশ্বের সর্বত্র অসংখ্য আদর্শ সুক্ল, শিশু সদন, ত্রাণ কেন্দ্র, সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মাষ্টার ইয়ূনিট সহ বহু সেবা ও উন্নয়ন প্রকল্প৷ যাঁর আশীর্বাদ ও প্রেরণা নিয়ে আনন্দমার্গ অত্যল্পকালের মধ্যেই বিশ্ব সংঘটন রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে তিনি হলেন সেই সংঘটনেরই জনক ও গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই বিশ্ব সংঘটন আনন্দমার্গের বীজ বপন করে ছিলেন ১৯৩৯ সালে শ্রাবণী পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বয়স তখন ছিল মাত্র ১৮ বছর৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নামেই তিনি তখন পরিচিত৷ তিনি তখন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র৷ যুবক প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস মত কলিকাতার কাশীমিত্র শ্মশান ঘাটে সান্ধ্য ভ্রমণে এসেছেন৷ জগৎ–সংসার, প্রবৃত্তি–নিবৃত্তি, প্রেয়–শ্রেয়, বন্ধন ও মুক্তি নিয়ে গভীর চিন্তায় তন্ময় তিনি৷ হঠাৎ প্রভাতরঞ্জন দেখতে পেলেন তাঁর সামনে এক অদ্ভূত দর্শন বিশাল দেহী মানুষ৷ হাতে তার উদ্যত শাণিত খড়গ৷ আক্রমণোদ্যত হয়ে সব কিছু কেড়ে নেবার জন্যে সে এগিয়ে আসছে৷ দৈত্যসম মানুষটিকে চিনতে তরুণ প্রভাতরঞ্জনের কিন্তু এতটুকুও অসুবিধা হ’ল না৷ জ্বল জ্বলে চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে ডাকলেন–‘কালীচরণ’৷

দুর্ধর্ষ কালী ডাকাত (কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) কেমন যেন সুবোধ বালকের মত এগিয়ে এল৷ কেমন যেন আবিষ্ট হয়ে পড়েছে সে৷ প্রভাতরঞ্জন তাঁকে শুধোলেন–‘‘কালীচরণ তুমি কি চাও? বল তোমার কিসের অভাব আছে?’’

উভয়ের মধ্যে কিছুক্ষণ কথোপকথন চলল৷ সেই জ্যোৎস্নালোকিত সান্ধ্য আলাপের ফলশ্রুতিতে কালীচরণের হাত থেকে খড়গ খসে পড়ল৷ বহু ইতিহাসের সাক্ষী, বহু সভ্যতার জননী গঙ্গার গৈরিক জলে স্নান সেরে নম্র হয়ে ধীর পদক্ষেপে সে এসে দাঁড়াল তরুণ প্রভাতরঞ্জনের সামনে দীক্ষা প্রার্থী হয়ে৷ তরুণ প্রভাতরঞ্জন তখন আনন্দঘন–করুণাঘন্ মঙ্গল মূর্ত্তি৷ দীক্ষা দান সমাপ্ত হ’ল৷ কালীচরণের জীবনে এক নোতুন ঊষার স্বর্ণদুয়ার খুলে গেল৷ দুর্ধর্ষ ডাকাত কালীচরণ পা বাড়ালেন মহাতান্ত্রিক, মহাসাধক কালিকানন্দ অবধূতের জীবন দিগন্তে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সেদিনই কালীচরণের তথা বিশ্ববাসীর গুরুরূপে সর্বপ্রথম নিজেকে প্রকাশিত করেন৷ তাই শ্রাবণী পূর্ণিমা দিনটি সমস্ত আনন্দমার্গীদের কাছে, সমস্ত বিশ্ববাসীর কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র দিন৷ এই দিনটিতেই মানব মুক্তির মহামন্ত্রে দীক্ষিত হলেন কালীচরণ  পৃথিবীর মানুষ পেল মুক্তির পথ, প্রজ্ঞার পূর্ণিমার আলোয় জগৎ হ’ল উদ্ভাসিত৷

সমবেত ধ্যান, কীর্ত্তন, ধর্মচক্র, ধর্মালোচনা, সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র এই দিনটিতে উৎসব পালিত হয়৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শুধু মুমুক্ষু মানবতাকে মুক্তি পথের নির্দেশনা দিয়েই তাঁর গুরুর ভূমিকাকে সীমায়িত করে রাখেননি৷ তিনি তাঁর গুরুর ভূমিকা ব্যপ্ত করে দিয়েছেন মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, জ্ঞানের প্রতিটি শাখা–প্রশাখায়৷ ধর্ম–দর্শন, শিক্ষা–সংসৃক্তি, অর্থনীতি, রাজনীতি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষা বিজ্ঞান–সর্বত্র তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রজ্ঞার ভাস্বরতা৷ তাঁরই রচিত ও সুরারোপিত প্রভাত সঙ্গীতের সংখ্যা ৫০১৮, যা সংগীত জগতের ভাব–ভাষা–সুরের বিচিত্রতায় অভিনবত্ব দাবী করে৷ সর্বোপরি তিনি রচনা করে গেছেন এমন একটি বিশ্ব সংঘটন যা সমাজের আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক অভাব দূর করার মহান ব্রতে নিবেদিত৷

মহাগুরু, মহাযোগী, মহাজ্ঞানী শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তাঁর পিতৃসম মমত্ববোধ ও বাৎসল্যের দ্বারা শুধু মানুষের নয় এমন কি পশু–পক্ষী–উদ্ভিদ জগতের সবার কল্যাণ করে গেছেন৷ সবার কল্যাণের বিধান দিয়ে গেছেন৷ শ্রাবণী পূর্ণিমার এই পুণ্যদিনে তাঁরই চরণে প্রণত হয়ে আমরা তাঁর আশীর্বাদ ভিক্ষা করি৷ প্রার্থনা করি–‘তিনি আমাদের সবার বুদ্ধিকে শুভ ও কল্যাণের পথে চালিত করুন৷’

শুধু কালীচরণ নয়, শুভ–শুভ দ্বন্দ্ব, আলো–আঁধারের খেলা সব মানুষের মনেই সতত চলছে৷ তাই শ্রাবণী পূর্ণিমার এই পূণ্য তিথিতে বিশ্বমানবের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যাক–মানুষ তুমি অন্ধকার থেকে আলোতে, অন্ধকার থেকে আত্মজ্যোতিতে প্রতিষ্ঠিত হও৷