সত্য আর অসত্যের ভেদ

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

সত্যের পরিবর্তন হয় না৷ পরিবর্তন হ’লে পরিবর্তিত অবস্থায় সেটা সত্য নয়৷ যার পরিবর্তন হয় না, সেটা সত্য৷ তা ত্রিকালেই একরূপ থাকে৷ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান তিন কালেই একরূপ থাকার দরুণ তা কালাতীত কেবল কালাতীতই নয়, দেশাতীত ও পাত্রাতীতও৷ সত্য দেশ, কাল, পাত্রের অতীত৷ তার নিজের শরীরেও ভেদ নেই, এক অংশের সঙ্গে অপর অংশেরও ভেদ নেই৷ ব্রহ্ম বা সত্য এক অখণ্ড, অবিচ্ছিন্ন ও অপরিণামী সত্তা৷ সত্যের মধ্যে ভেদ নেই, তাহলে কি বাহ্যিক বস্তুর সঙ্গে ভেদ আছে ? --- না, ভিতর তথা বাইরেও ভেদ নেই৷ তাঁর বাইরে আর কিছুই থাকতে পারে না, থাকলেই ভেদ এসে যাবে৷ আবার ঠিক তাঁর মত অপর বস্তুও তো বাইরে থাকতে পারে! যা অখণ্ড ও যার টুকরো নেই, তাঁর সীমাও নেই৷ অতএব তাঁর তুল্য বস্তুও তার ভিতরেই থাকবে৷

সত্যে স্বজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ নেই৷ আম গাছ যদি সত্য হয়, তাহলে জগতে আর অন্য জাতীয় গাছ থাকবে নাকিন্তু এরূপ নয়৷ অতএব আম গাছ পরম সত্য নয়--কেন না বিজাতীয় ভেদ আছে, আমের স্বজাতীয় ভেদও আছে, যেমন বোম্বাই, কিষণভোগ ইত্যাদি৷ এতে স্বগত ভেদও আছে ---যেমন পাতা, মুকুল আর ফল ইত্যাদি৷ অতএব এটি সত্য নয়৷ এটি আপেক্ষিক সত্য অথবা অসত্য৷

আপেক্ষিক সত্য (relative truth) বা মিথ্যা, দেশ, কাল ও পাত্রাদি গত৷ এটি দেশ, কাল ও পাত্রের ওপর নির্ভর করে৷ চাঁদকে এখান থেকে একটি বড় বগি-থালার মত দেখায়, কাছে গেলে অনেক বড় মনে হয়৷ তাহলে সত্য সত্যই, তা কত বড়? ছোট বা বড় দূরত্বের ওপর নির্ভর করে, দেশের ওপর নির্ভর করে৷ অতএব তা পরম সত্য নয়- আপেক্ষিক সত্য৷

মুঙ্গের, কাছের রাস্তা দিয়ে ভাগলপুরের পশ্চিমে ও দূরের রাস্তা দিয়ে পৃথিবী ঘুরে গেলে, ভাগলপুরের পূর্বে৷ এটা তো একমাত্র দেশের ওপরেই নির্ভর করছে৷ তাহলে একে পরম সত্য কি করে বলা যাবে? যার চোখ হলদে (কামলা বা ন্যাবা রোগী) সে সবই হলদে দেখে, কিন্তু অপর ব্যক্তি: অন্যরূপ দেখে৷ এটি পাত্রের ওপর নির্ভর করে, কাজেই পরম সত্য নয়৷ অতএব একমাত্র পরমাত্মাই পরম সত্য (absolute truth)৷

দেশ, পাত্র তো দেখা গেল পরম সত্য নয়৷ এবার কালের ওপরেও বিচার করা যাক৷ একটা ঐতিহাসিক ঘটনাকে কতটা সত্য বলতে পারি? ধর, মহাভারতের যুদ্ধ ৩২৫৩ সাল পূর্বে হয়েছিল৷ আমাদের আলোকের light) দ্বারা দর্শন জ্ঞান হয়৷ তুমি আকাশের তারা দেখতে পাও, যখন তার থেকে রশ্মি light) তোমার অক্ষিগোলকে এসে পড়ে৷ মহাভারতীয় যুগের রশ্মি কোনও তারায় পৌঁছাতে মনে কর এখান থেকে আরও ৮০০ বছর লাগবে৷ এই সময় সেখান থেকে যদি কেউ দূরবীণের সাহায্যে পৃথিবীর দিকে দেখে, তাহলে সে পৃথিবীতে কী দেখবে? সে দেখবে---এখনও মহাভারতের যুদ্ধ হয়নি৷ আরও ৮০০ বছর পরে হবে ও ৮০০ বছর পরে সত্য সত্যই সে মহাভারতের যুদ্ধ হতে দেখবে৷ কারও কাছে যা অতীত, অন্য কারও কাছে তাই বর্তমান ও কারও জন্যে তা ভবিষ্যৎ৷ এ সবই আপেক্ষিক সত্য (relative truth) শব্দের ব্যাপারও দেখা যাক৷ বেশী জোরে বললে কেউ বলবে চেঁচাচ্ছে, কিন্তু কালা লোক বলবে--- আস্তে বলছে৷

অন্নময়, মনোময়, অতিমানস, বিজ্ঞানময়, হিরণ্য ও তারপর সত্য৷ সত্যে প্রতিষ্ঠিত হ’লে ত্রিকালজ্ঞ হয়, আর সেই হয় সত্যদ্রষ্টা, তার কাছে কোথাও কোনো ভেদ নেই৷ ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন, কিন্ত ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হ’লে ভেদ থাকে না৷ মানুষ সাধনা করে, মনকে লুপ্ত করে ত্রিকালজ্ঞ হতে পারে৷ কিন্তু মনকে লুপ্ত করতেই হবে, কারণ তা আপেক্ষিক সত্য ও সেই কারণেই সে পরম সত্যকে জানবার অধিকার রাখে না৷*

যেখানে ক্রিয়া আছে, সেখানেই গতিশীলতা আছে৷ ক্রিয়ার গতিশীলতার মানসিক পরিমাপের (mental measurment) নাম কাল৷ যেখানে ক্রিয়া নেই, সেখানে মন নেই৷ ক্রিয়া আছে, কিন্তু ক্রিয়াকে মাপার জন্যে মন নেই, এজন্যে কালও নেই৷ যেমন কেউ যদি তিন ঘণ্টা অজ্ঞান অবস্থায় থাকে, তাহলে ওই তিন ঘণ্টা অতীত হওয়াটা তার ৰোধগম্য হবে না৷ ক্রিয়া ও মন আপেক্ষিক সত্য relative truth), এজন্যে কালও আপেক্ষিক সত্য৷ কাল নির্ভর করে দেশ ও পাত্রের ওপর, আর দেশ, পাত্র নির্ভর করে কালের ওপর৷ লোকে বলে যে কাল এক অনাদি, অবিচ্ছিন্ন ও অনন্ত সত্তা, একথাটা সত্য নয়৷ দেশ, পাত্র না থাকলে কাল থাকতে পারে না৷

মানুষ ছোট বা বড় সব বস্তু থেকেই সুখ পায় বা পেতে চায়, কিন্তু আপেক্ষিক সত্য থেকে কালাতীত আনন্দ পেতে পারে না৷ এজন্যে বুদ্ধিমানেরা কালাতীত সত্তারই সাধনা করে থাকেন৷ দেহ, মন, এসব কালাতীত নয়৷ এদের পেছনে ছোটা---বোকামি৷ এদের জন্যে যত্ন নাও কিন্তু এদের সাধনা করো না সাধনা করে যাও কালাতীতে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে৷