কালচক্রের বিরাম নেই৷ সে চলে চলেছে অসীমের পানে৷ আমরাও চলে চলেছি তার সাথে৷ এই চলার পথে আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে কখনো কখনো এমন ক্ষণজন্মা মহামানব জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা তাঁদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃৃতা, নৈতিকতা ও অন্যায়–শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের জন্যে মানুষের সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন৷ ঘুরে ঘুরে সেই ২৩ শে জানুয়ারী আবার আসছে আমাদের জানাতে–কৈ, তোমরা তৈরী হয়েছো তো দেশবরেণ্য নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁর অসমাপ্ত কর্মকে সমাপ্ত করতে? তিনি ছিলেন এই বাংলার মায়ের দামাল ছেলে৷ সমগ্র দেশ এই দামাল ছেলের আত্ম্যত্যাগে গর্বিত ও ধন্য৷ আমরা কি তাঁর পথে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছি? মনে হয় না৷ যদি হতাম তাহলে এই হতভাগ্য দেশের ছবি অন্য রকম হতো৷ তিনি এমনই ব্যষ্টিত্বের অধিকারী ছিলেন যে ছাত্রাবস্থাতেই প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ওটেনকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন দেশ জননীর অপমান করায়৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ ইংরেজ শোষককে তিনি কিক্ আউট করার ডাক দেন৷ তিনি কোন দিনই শোষককে তৈল মর্দন করে’ দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন নি৷ তাই তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দিতে আজও এদেশের নেতারা মুখ ঘুরিয়ে থাকেন আজও ইংরেজের স্তাবকগণ এদেশের মাটিতে তাঁকে মর্যাদা দেননি৷ দেশ ৬৩ বছর রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দুর্নীতির নিরিখে ভারতের স্থান অনেক নীচে৷ এটা বলারই দরকার হয় না৷ কারণ যাঁরা গত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্টের আগে জন্মেছেন তাঁরা তাঁদের জীবিত কালেই স্বচক্ষে দেখেছেন সেদিনের ভারত কেমন ছিল আর আজকের ভারতের দশাটা কেমন৷
সেদিন স্বাধীনতার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন তাঁদের একটাই লক্ষ্য ছিল, তা হলো পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা অর্জন৷ কিন্তু স্বার্থান্বেষীরা নিজেদের দলীয় ও ব্যষ্টিগত স্বার্থে নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে কলঙ্কিত করে তাঁর চরিত্রে দাগ দিয়ে চোরে চোরে মাসতুতোভাই হিসেবে শোষক ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ জননীকে দু’টুকরো করে বসলো৷ তাঁদের অদূরদর্শিতার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা মিঃ জিন্নাকে খাড়া করে ভারতবর্ষের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেল৷ আজকের কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট দলের নেতারা সেদিন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ও ইংরেজের স্বার্থ রক্ষা করতে মুক্তকচ্ছ হয়ে কাজ করে গেছেন৷ যা নেতাজী সারা জীবনে মানতে পারেন নি৷ দেশভাগ না করার জন্য তিনি দেশের বাইরে থেকেও আবেদন জানিয়ে গেছেন৷ নেতাদের অনুরোধ করে গেছেন তাঁরা যেন ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য দাঁতে দাঁত দিয়ে সংগ্রাম করেন৷ তা করলে সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দালালদের স্বার্থসিদ্ধি হতো না৷ কিন্তু আমাদের এদেশের নেতারা নেতাজীর আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের জন্ম দেন ও নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন৷ সুভাষচন্দ্রকে সেদিনের কংগ্রেসের বৃদ্ধ নেতারা ও খোদ জওহরলাল সহ্য করতে পারতেন না৷ তাই পট্টভিয়া সীতারামাইয়ার পরাজয়কে তাঁরা মেনে নিতে পারেন নি৷ সুভাষচন্দ্র যখন বুঝলেন যে কংগ্রেসের বিরাট অংশ তাঁকে সহ্য করতে পারছেন না তখন কংগ্রেস দল ত্যাগ করেন ও ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরী করেন৷ তখন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে৷ তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করে বুঝেছিলেন ভারতের স্বার্থে ইংরেজকে চরম আঘাত হানার সময় হয়েছে৷ কিন্তু কংগ্রেসের বৃদ্ধ নেতারা ইংরেজকে প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আঘাত না হেনে নরম মনোভাব দেখাবার নীতি গ্রহণ করেন৷
নেতাজী আপোষহীন সংগ্রামী ছিলেন৷ সেটা ইংরেজ সরকার বুঝতো তাই তাঁকে ‘টি’ (টাইগার) হিসাবে চিহ্ণিত করতো৷ বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার এলগিন রোডের বাড়িতে সুভাষচন্দ্রকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখে, যখন অন্য দলের নেতারা বাইরে নিরাপদে ঘুরে বেড়াতেন৷ এই সময় জীবন বিপন্ন করে তিনি গৃহত্যাগ করেন ও ইংরেজের চোখে ধূলি দিয়ে ছদ্মবেশে ভারতের বাইরে চলে যান ও ইংরেজকে বিতাড়িত করার কাজে ‘‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ এই নীতিকে অবলম্বন করে অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মেলান৷ হিটলারের সহায়তায় তিনি জাপানে যান৷ জাপানে মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সহায়তায় যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তোলেন৷ সুভাষচন্দ্র সেই বাহিনী নিয়ে অবিভক্ত ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ও শত বাধা বিপত্তি অস্বীকার করে সেই বাহিনীর সাহায্যে মণিপুরে প্রবেশ করে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড্ডীন করেন৷ এ ইতিহাস অনেকেই জানেন৷ কিন্তু নেতাজীর শেষ জীবনের রহস্য আজও সকলের অজ্ঞাত, জাপানের মাটিতে যে তাঁর দেহ–ভস্মের গল্প সেটা নিছক এক মিথ্যাচার ও রটনা মাত্র৷ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয় যে এই রটনার কারণ কংগ্রেসী সরকার অদ্যাবধি চান না যে নেতাজীর রহস্য উদঘাটিত হোক৷ চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি কমিশন গড়েন, যাতে নেতাজীর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়৷ কিন্তু সেটা ছিল লোক দেখানো৷ ইন্দিরা গান্ধীর শাহ্নওয়াজ ও খোসলা কমিশন তো একেবারেই সেই ‘হিজ মাস্টার ভয়েজে’র মতো কাজ করে গেছে৷ শেখানো পড়ানো উক্তিই ওই রিপোর্টে ছিল৷ পরে মুখার্জী কমিশন অনেক বিরোধিতা ও বাধা অতিক্রম করে যে রিপোর্ট পেশ করেন সেটা কংগ্রেস সরকার এক কথায় খারিজ করে দেন৷ পশ্চিমবঙ্গের এম পিরা সমবেত ভাবে তেমন প্রতিবাদও করেন নি৷ ফরোয়ার্ড ব্লকের উচিত ছিল তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার৷ মোদ্দা কথা, তাইহকু বিমানবন্দরে নেতাজীর বিমান দুর্ঘনায় মৃত্যু হয়নি–এটাকে তিনি (মিঃ মুখার্জী) প্রমাণ করে দিয়েছেন৷ আর এই মৃত্যুকে মূলধন করে এতদিন এদেশের স্বাধীন (?) সরকার নেতাজীকে ‘ছবি’তে পরিণত করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছেন৷ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একমাত্র কংগ্রেসই প্রধান ভূমিকায় ছিল– এটা প্রতিপন্ন করতে দিল্লীর কংগ্রেসী ও বিরোধী নেতারা চেয়েছিলেন৷
দেশের মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতাজীকে আজও ভোলেননি৷ তাই সারা ভারত তাঁকে আজও অবিস্মরণীয় নেতাজী হিসাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে থাকেন৷ জওহরলাল ও তাঁর সমর্থকগণ নেতাজীকে সহ্য করতে পারতেন না তাই নেতাজীর চিন্তা–ভাবনাকে অর্থাৎ আপোষহীন সংগ্রামী মনোভাবকে তাঁরা এড়িয়ে যেতেন ও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভয় পেতেন৷ দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে অনবদ্য ও অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত৷ পৃথিবীর ইতিহাসে মনে হয় এমন দুঃসাহসিক দেশপ্রেমিক বিরল৷ মনে রাখা দরকার তিনি যে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ করেছিলেন তার প্রেরণা তিনি লাভ করেন ভারতবর্ষের তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের অনবদ্য লেখাগুলি হতেই৷ তিনি ছিলেন স্বামীজীর মানসপুত্র৷ ছাত্রাবস্থায় তিনি এক বন্ধুকে নিয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছায় হিমালয়ের উদ্দেশ্যে গমন করেন বাড়ির অভিভাবকদের অজ্ঞাতে৷ তিনি সবান্ধব হাজির হন আলমোড়ার এক আশ্রমে৷ সেখানে জনৈক সন্ন্যাসী যিনি স্বামীজীর গুরুভাই ছিলেন, তিনি সুভাষকে দেখে বলেন যে দেশের কাজে যেন সে আত্মনিয়োগ করে৷ সেই কারণে আজীবন তিনি সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করতেন৷ তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল গীতা, রুদ্রাক্ষের মালা ও গেরুয়াবস্ত্র৷ তিনি আই এন এর সর্বাধিনায়ক হয়েও প্রত্যহ সাধনা করতেন সন্ন্যাসীর মতোই৷ ভারতমাতা ছিলেন তাঁর আরাধ্যাদেবীর মতই৷ তাঁর শৃঙ্খল–মুক্তির সংগ্রামে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন৷ অদ্যাবধি এমন কোন দেশনেতা জন্মালেন না যিনি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ সেবায় মন দেন৷ নেতাজী আজও অমর হয়ে আছেন৷ বর্ত্তমান ভারতে যেভাবে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দলবাজি চলছে তার হাত থেকে হতভাগ্য দেশকে রক্ষার জন্যে তাঁর নির্দেশিত পথই হ’ল প্রকৃত পথ৷
তাই বলি দেশ–এর সার্বিক কল্যাণে মহান নেতা নেতাজীকে যদি সত্যই শ্রদ্ধা জানাতে হয় তাহলে তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে হবে দেশের তরুণ তরুণীদের৷ শুধু ২৩ শে জানুয়ারী মাত্র একদিন তাঁর ছবি নিয়ে হই চই করে কোন কাজের কাজ হবে না৷
প্রাউট প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নেতাজী সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেন তা চিরস্মরণীয় ও স্মর্তব্য–তিনি বলেন–... সেই সুভাষচন্দ্র বসুকে কে না জানে পৌরুষের বজ্র কৌস্তুভ.....রাজনীতির জ্বলন্ত ধূমকেতু......উল্কার অনলশিখা৷...
বিংশ শতাব্দী চলে গেছে নানা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে৷ ভারতবর্ষ খণ্ডিত হয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছে মাত্র৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দূরস্ত৷ একবিংশ শতাব্দীর ভারতীয়দের তাই দ্রুত তালে কাজ করে যেতে হবে যাতে শোষিত, নিপীড়িত কোটি কোটি দেশবাসী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেন ও প্রকৃত স্বাধীনতার সাফল্য ভোগ করেন৷
এই শুভ কাজ যখন সম্পন্ন হবে অর্থাৎ প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে তখনই নেতাজীর মহান আত্মত্যাগ সার্থক হবে৷
স্বামীজীর সেই কথা স্মরণে আছে–
''Most of the people will hate you,
Don't pay head, great giant,
onward! onward! and onward.''
এপথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্ঢকাকীর্ণ৷ তাই বীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান নেতার আজীবনের বাসনাকে পূর্ণ করো৷ তাই বলি –‘হে, ভারতের যুবসমাজ৷ দেশ মাতা সাশ্রুনয়নে তোমাদের পানে তাকিয়ে আছেন৷ এগিয়ে এসো৷ বলা বাহুল্য, নেতাজী ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন ‘প্রাউট’ দর্শনে তারই প্রকাশ ঘটেছে৷ এক সময় প্রাউটিষ্টদের একটা দেওয়াল লিখন চোখে পড়েছিল–
‘‘সীমান্ত হতে ভাসিয়া আসিছে নেতাজীর নির্দ্দেশ
প্রাউটের ডাকে হও সবে এক বাঁচাও আজিকে দেশ৷’’
প্রকৃতপক্ষে আজ এই পথই দেশ তথা মানব জাতির বাঁচবার পথ৷
- Log in to post comments