অচেনা শরৎ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিনহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

বর্তমানে দুর্গাপূজা অলিতে গলিতে, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে অনুষ্ঠিত হলেও মূলতঃ এটি শুরু হয়েছিল ধনী জমিদারদের প্রতিযোগিতামূলক জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ পূজা অনুষ্ঠান হিসেবে৷ সাম্প্রতিককালেও বিভিন্ন বড় বড় পূজাগুলি মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও বৃহৎ কর্পোরেট  সংস্থাগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলোর বাজেট কোটি কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়৷ বিশেষ কতকগুলি পূজা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভক্তিভাবের থেকে লোকদেখানো বাহ্যাড়ম্বরের বাহুল্যই  প্রকট৷ জাঁদরেল নেতা, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ব্যষ্টিদের দ্বারা পূজা উদ্বোধন থেকে শুরু করে প্রতিমা নিরঞ্জনের  বিশাল ঢাকঢোল , তাসাপার্টি, ডি জে, আতসবাজি প্রভৃতি সহকারে আলোঝলমলে শোভাযাত্রা পর্যন্ত সবখানেই অর্থশক্তির উৎকট প্রকাশ৷ ওই সব বিশাল বিশাল প্যান্ডেলের পাশে, রাজপথের ধারে, ব্রীজের তলায় কতশত মানুষ অনাহারে, অর্র্দ্ধহারে, অশিক্ষা কুশিক্ষায়, চিকিৎসার অভাবে দিনাতিপাত করে চলেছে৷ সমগ্র শহর, নগর যখন উৎসব মুখর, সেই সময় এইসব মানুষেরা ছিটেফোঁটা ভোগ প্রসাদ বা দাক্ষিণ্যের কণাটুকু জোগাড়ে ব্যস্ত৷ চতুর্দিকে দেবদেবীর অর্চনা অথচ জীবন্ত দেবদেবী তথা পরমপুরুষের সন্তান সন্ততি চরম অবহেলায় উপেক্ষিত৷ মুষ্টিমেয় পূজা উদ্যোক্তার সদিচ্ছায় কিছু জনহিতকর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়৷ তবে তা সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র৷ তাই তো কবি বলেছেন---

‘‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর,

জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর৷’’

মন্ডপে মন্ডপে, মন্দিরে মন্দিরে কল্পিত দেবদেবীর কাছে মাথা ঠুকে  ধনং দেহি, যশং দেহি, জয়ং দেহি ইত্যাদি প্রার্থনা না করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্র্ত পরমব্রহ্মের মূর্ত প্রকাশ সমগ্র জগতের কল্যাণ ওই বিপুল অর্থের বৃহদংশ ব্যয় করতে পারলে একদিকে যেমন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন করা যাবে, অপরদিকে পরমপিতার  সন্তান সন্ততিদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে তাঁর করুণধারাও বর্ষিত হবে৷

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব৷ সমাজ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের পারস্পরিক  প্রয়োজনে৷ আমরা কেউই সবকাজ  নিজে নিজে করতে পারি না৷ সকলের সাহায্য নিয়েই আমরা বাঁচতে পারি৷ মানুষই নয়, অন্যান্য জীবজন্তু, উদ্ভিদ,বায়ু, জল, জড় খনিজ, সবাইকে নিয়েই আমাদের সমাজ৷ সমাজকে সকলের বাসযোগ্য করতে হলে সকলের জন্যেই ভাবতে হবে, উন্নতির চেষ্টা করতে হবে৷ এরই নাম নব্যমানবতাবাদ৷ ‘‘সমানম এজতে  ইতি সমাজঃ৷’’ সবাইকে ভালোবেসে সকলকে নিয়ে একসঙ্গে প্রকৃত উন্নতির  লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই  আমাদের জীবনের  মূল উদ্দেশ্য৷ সুতরাং ক্ষুদ্র-খণ্ডের মোহে আবদ্ধ না থেকে ‘নব্যমানবতাবাদ’-এর প্রয়োগে ‘সংগচ্ছধবং’ মন্ত্রে  উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রকৃত সমাজ  রচনা করার মধ্যেই  রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের  সার্থকতা৷ তাই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সৃষ্টিকর্র্তর  সকল সৃষ্টিকে তাঁরই প্রকাশ ভেবে সেবার ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারলেই আমাদের উৎসব উৎযাপন সার্থক হয়ে উঠবে৷ আর তখনই আমাদের  অন্তরের  গভীরে পরমপুরুষের দিব্য উপস্থিতি অনুভব করতে পারবো--- এভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই৷ তখনই আমাদের অস্তিত্বের প্রতি অণু পরমাণুতে গুঞ্জরিত হয়ে উঠবে প্রভাত সঙ্গীতের সুর---

‘‘তুমি নেই কোনখানে গো বলো মোরে বলো মোরে৷

যেদিকে তাকাই তোমাকেই পাই সরিতা-সায়রে গিরিশিরে৷

আছো অনলে অনিলে দূর নভোনীলে,

ভূধরে নীহারে বিটপীর মূলে৷

মারব সাগরে শষ্প শ্যামলে বিভীষিকাময় তিমিরে৷

তোমায় চেয়েছে কত নরনারী স্বদেশে বিদেশে তীর্থে ঘুরি৷

পায়নি কোথাও শত ক্লেশ বরি যে নাহি খুঁজেছে অন্তরে৷৷’’                (প্রঃসঃ সংখ্যা-৪৫৩৭)