সমাজচক্রের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালনের প্রয়োজনে মানুষের সমাজে কিছু সংস্থার উদ্ভব হয়৷ তাদের মধ্যে রাষ্ট্র হ’ল একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা৷ একটা বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী কোন জনগোষ্ঠী নিজের মঙ্গল ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের শাসন পরিচালনার জন্যে যে সংস্থার সৃষ্টি করে তাই হ’ল রাষ্ট্র৷ এই সংস্থা খুবই শক্তিশালী কারণ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা তারই হাতে ন্যস্ত৷
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার যদি কোন আইন বা আদর্শের দ্বারা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা না করা হয়৷ যে নির্দেশক পুস্তকে রাষ্ট্রের আচরণবিধি, আইন ও আদর্শকে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে বলি সংবিধান৷ সংবিধান ও শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রকে তার নীতি ও আদর্শের সাহায্যে জনসাধারণকে দ্রুত প্রগতি ও সার্বিক উন্নয়নমূলক সেবাকাজের উদ্দেশ্যে পরিচালনা করে৷
বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান রচিত হয়েছিল আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালীর লিচ্ছবি রাজত্বকালে৷ তার আগে রাজার মুখের কথাই ছিল আইন, আর রাজা মন্ত্রিমণ্ডলীর উপদেশ অনুসারেই রাজ্য শাসন করতেন৷ প্রথম প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লিচ্ছবিদের দ্বারা৷ লিচ্ছবিরাজ্যের এলাকা ছিল বর্ত্তমান বিহারের মুজাফফরপুর, বেগুসরায়ের কিয়দংশ, সমস্তিপুর, গণ্ডক ও কমলা নদীর অন্তর্বর্তী হাজিপুর নিয়ে৷ লিচ্ছবি রাজ্যই ছিল বিশ্বে প্রথম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যাদের নিজস্ব লিখিত সংবিধান ছিল৷
ব্রিটিশ সংবিধান বলে কিছু নেই, এর কোন লিখিত রূপ নেই৷ এ শুধু কতকগুলি লোকাচার ও দেশাচারের সংকলন৷ তত্ত্বের দিক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাজা অথবা রাণী৷ তত্ত্বতঃ সমস্ত রাষ্ট্রক্ষমতা রাজা বা রাণীর হস্তে ন্যস্ত কিন্তু বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীই সমস্ত ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের প্রধানরূপে কাজে লাগান৷ ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার (Presidential form of government)৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার৷ ফ্রান্স ও আমেরিকা উভয় দেশেরই লিখিত সংবিধান রয়েছে৷ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তাঁর সেক্রেটারীদের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করেন ও দেশশাসন করেন৷ রাষ্ট্রপতি জনসাধারণ কর্ত্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন, তিনি মন্ত্রিমণ্ডলী গঠন করেন না, পরিবর্ত্তে কিছু সংখ্যক সেক্রেটারী নিয়োগ করেন৷ কিন্তু ফ্রান্সে মন্ত্রিমণ্ডলী আছে৷ যখন ব্রিটেনে কোন মন্ত্রিমণ্ডলী থাকে না তখন রাজা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভা (Lame-duck ministry) তৈরী করে নেন৷ যতদিন না নির্বাচনের মাধ্যমে নোতুন সংসদ গঠিত হচ্ছে ততদিন এই অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা দিয়ে রাজা কাজ চালান৷ ভারতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেই বললেই চলে, তিনি শুধু সই দেন বা রাবার–ষ্ট্যাম্প৷ রাষ্ট্রপতির এমন ক্ষমতাও নেই যার দ্বারা তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে (care-taker) পরিচালিত করতে পারেন৷ ভারতীয় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করতে পারেন না৷ অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে সংবিধানে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি জনসাধারণ কর্ত্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না৷ তিনি প্রথমে সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তারপর তাঁর দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে৷ রাষ্ট্রপতিশাসিত আমেরিকার সংবিধান তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সংবিধান থেকে ভালো, কিন্তু আমেরিকার সংবিধানেও কিছু ত্রুটি আছে৷ আর সেই ত্রুটি হ’ল এই যে বৈয়ষ্টিক অধিকারের ওপর সেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে৷ এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হ’ল নিরঙ্কুশ পুঁজিবাদ৷ ভারতবর্ষেও আজ সেই একই দুরবস্থা তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতে আজ আঞ্চলিকতাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে৷ আদর্শ সংবিধান রচনার জন্যে অতিরিক্ত ব্যষ্টি স্বাধীনতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন যাতে সমষ্টির স্বার্থ সর্বাধিক গুরুত্ব পায়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নিশ্চিততা নেই৷ রাষ্ট্রপতি চালিত সরকার হ’ল সর্বশ্রেষ্ঠ সরকার৷ রাষ্ট্রপতিকে প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে হবে৷ আর সেখানে ব্যষ্টিস্বাধীনতা অবশ্যই কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হবে৷
সংবিধানের সাধারণ কতকগুলো ত্রুটি ঃ
প্রতিটি মানুষেরই জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের অধিকার আছে৷ কিন্তু কিছু কিছু দেশের সংবিধান এমনভাবে লিখিত হয়েছে যে সেখানে সকল মানুষের সার্বিক বিকাশের কোন সুযোগ রাখা হয়নি৷ সংবিধান হবে ত্রুটিমুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত৷ সংবিধান যাঁরা রচনা করবেন, তাঁদের পক্ষে বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতিকে বিপন্ন করতে পারে৷ এর ফলস্বরূপ সমাজের সামগ্রিক শান্তি ও সমৃদ্ধি বিঘ্ণিত হয়৷
এ বিচারে ভারতীয় সংবিধানের কিছু কিছু ত্রুটি আমাদের চোখে পড়ে৷ মনে রাখতে হবে, এই ভারতবর্ষ একটি নানান জাতি–ধর্মমত–বর্ণ বাসভূমি৷ তাই যে দেশ বা রাষ্ট্রে এত বৈচিত্র্যময়তা তার সংবিধান রচনা করতে গিয়ে সংবিধান–প্রণেতাদে সকল দিকে নজর রাখতে হবে যাতে এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও একটা সুগভীর ঐক্য ও সংহতি গড়ে ওঠে৷
ভারতের জনসংরচনার বৈশিষ্ট্য হ’ল এই যে এখানে অষ্ট্রিক, মঙ্গোলীয়ান, নিগ্রোয়েড ও আর্য এই চারি জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উদ্ভুত এক সংকর ত্ব্প্তন্দ্বুস্তুন্দ্বস্তুগ্ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, কিন্তু ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্নিহিত ত্রুটির কারণে এই সব বিভিন্ন জাতির মধ্যে সামাজিক নৈকট্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার (cultural legacy), সমতাবোধ ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জেগে উঠেছে৷
ভারতীয় সংবিধানের কয়েকটি অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটি ঃ
ভারতীয় সংবিধানের যে সমস্ত অর্থনৈতিক ত্রুটি আছে তার মধ্যে অন্যতম হ’ল–এখানে পুঁজিপতি শোষণকে প্রতিহত করার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ কোন অর্থনৈতিক আন্দোলন করেন নি৷ তাঁদের আন্দোলন ছিল শুধু ব্রিটিশ–বিরোধী আন্দোলন যার ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, তা কখনই অর্থনৈতিক আন্দোলনের রূপপরিগ্রহ করেনি৷ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর শ্বেত জনগোষ্ঠীর শাসন ও শোষণের অবসান ঘটল ঠিকই কিন্তু বাদামী জনগোষ্ঠীর শোষণ (brown exploitation) শুরু হ’ল৷ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায় শুধু রাজনৈতিক মুক্তি এসেছে, অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি৷ আজও সেই অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রয়েছে৷
দ্বিতীয়তঃ এই সংবিধানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কোন ব্যবস্থাই নেই৷ তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রপতির হাতে এমন কোন ক্ষমতা নেই যার দ্বারা তিনি রাষ্ট্রীয়–অর্থনীতি সংক্রান্ত যে কোন বিষয় বা বিশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কতিপয় ব্যবসায়ী কর্ত্তৃক পরিচালিত ‘চেম্বার্স অব্ কমার্স’ নামে কয়েকটি সংস্থার দ্বারা৷ দ্রব্যমূল্য নির্দ্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা অথবা অর্থনৈতিক শোষণকে প্রতিহত করার কোন ক্ষমতা ভারতীয় রাষ্ট্রপতির নেই৷ শুধু রাষ্ট্রপতি নন, প্রধানমন্ত্রীও এই অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না৷ চতুর্থতঃ সংবিধানে সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ পঞ্চমতঃ দেশে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত কোন স্বচ্ছ ধারণাও এই সংবিধানে নেই৷
এছাড়াও ভারতীয় সংবিধানে কতকগুলো মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটিও রয়েছে৷ প্রথম ত্রুটি হ’ল জাতীয় ভাষা রূপে একটি বিশেষ ভাষাকে সমগ্র ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া৷ একটা বিশেষ অঞ্চলের ভাষাকে সংবিধান মারফৎ রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরিত করায় অন্যান্য ভাষাভাষীর ওপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য৷ সংবিধান কর্ত্তৃক এই ধরণের ত্রুটিপূর্ণ ভাষানীতি গৃহীত হবার ফলে অন্যান্য ভাষা–ভাষীরা জাতীয় স্তরে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ তাদের হিন্দী অথবা ইংরাজী শিখতে ও ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ অথচ হিন্দী বা ইংরেজী কোনটাই ভারতের জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত্ত স্বাভাবিক ভাষা নয়৷ এর ফলে অ–হিন্দী ভাষাভাষীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন৷ ভারতের মত বহু ভাষাভাষী, বহুজাতিক ও বহু সংস্কৃতি সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর জন্যে কোন অঞ্চল বিশেষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্থান দেওয়া উচিত নয়৷ এমন কোন ভাষাকে স্থান দেওয়া উচিত যা বিশেষ কোন অঞ্চলের ভাষা নয়৷ হিন্দী হ’ল তামিল, তেলুগু বা টুলু ভাষার মতই একটা আঞ্চলিক ভাষা৷ হিন্দী ভাষা হিসেবে যেমনই হোক না কেন জোর করে তা কখনই অন্যের ওপর চাপানো উচিত নয়৷
সংবিধানগতভাবে ভারতবর্ষ হ’ল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র, আর পাকিস্তান হ’ল ইসলামিক রাষ্ট্র ও নেপাল হ’ল হিন্দু রাষ্ট্র৷ তারা বিশেষ কোন ভাষাকে অপরের ওপর ইচ্ছা করলে চাপাতেও পারে, নাও চাপাতে পারে৷ কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা চলতে পারে না৷ ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হলে চাই সকলমানুষের মানসিক–সামাজিক–র্ উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে সমান সুযোগ ও সুবিধা৷
ভারতীয় সংসদে যখন রাষ্ট্র ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল তখন গণ পরিষদ এই প্রশ্ণে সমানভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল৷ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ সেদিন সেই সংকটজনক মুহূর্তে তার বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে হিন্দীর অনুকূলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন৷ তাঁর একটামাত্র জয়–পরাজয় নিষ্পত্তিমূলক বোটে (casting vote) হিন্দী ভারতের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি পেল৷ সংস্কৃত ভাষাকেই ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করা উচিত৷ সংস্কৃত হ’ল ভারতবর্ষের বর্ত্তমান ভাষাগুলোর প্রায় সকলেরই আদি জননী৷ এ ছাড়া অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ওপরেও সংস্কৃত ভাষার প্রভাব খুব বেশী৷ সংস্কৃত ভাষা শিখতে হয়তো ৫,১০,৫০ অথবা ১০০ বছরও লাগতে পারে৷ সংস্কৃতের নিজস্ব কোন লিপি নেই, তাই রোমন লিপি ব্যবহার করাই বিধেয়৷ যাই হোক্, সমস্ত জনগোষ্ঠী ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মিলিত হয়েই এ বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে একটা স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত৷
দ্বিতীয় মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটি হ’ল, আইনের দিক থেকে কতকগুলো বৈষম্য থেকে গেছে৷ ভারতীয় সংবিধান ঘোষণা করেছে যে, এখানে আইনের চোখে সকলেই সমান৷ কিন্তু বৈবহারিক ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসৃত হয় না৷ যার ফলে আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে নানারকম বৈষম্য দেখা দিয়েছে৷ এই বৈষম্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে৷ সকলেই ভারতরাষ্ট্রের নাগরিক অথচ সকলের জন্যে আইন সমান সুযোগ সুবিধা দেয়নি৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ, হিন্দু–আইনে একজন হিন্দু নাগরিক একাধিক বিবাহ করতে পারেন না কিন্তু মুসলিম–আইনে একজন মুসলমান নাগরিক একাধিক বিবাহের অধিকারী৷ হিন্দু স্বামী অথবা হিন্দু স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের দাবী নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয় কিন্তু একজন মুসলমান নাগরিক আদলতের সাহায্য ব্যতিরেকেই বিবাহ–বিচ্ছেদের অধিকারী৷ এছাড়া মুসলমান স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু একজন মুসলমান স্ত্রী তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করতে পারেন না৷ এছাড়াও মুসলমান স্বামীকে স্ত্রীকে ত্যাগের জন্যে কোন রকম কারণও দেখাতে হয় না৷ আইনের চোখে বৈষম্য এই ধরনের নানা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে৷ এই সব ত্রুটি আসলে সংবিধানের অন্তর্নিহিত মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটিজনিত ব্যাপার৷
সংবিধানে এক জনগোষ্ঠীর জন্যে এক আইন, ও অপর জনগোষ্ঠীর জন্যে অন্য ধরনের আইন–এই রকমই বা থাকবে কেন? সেখানে একটা আইন–ভারতীয় আইন–ই (The Indian Law) থাকা উচিত৷ এই ভারতীয় আইন অবশ্যই মৌল মানবীয় মূল্যবোধের (cardinal human values) ওপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকবে৷ তবেই বৈবহারিক ক্ষেত্রে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান–এই নীতির প্রতিষ্ঠা সম্ভব৷ আর তখনই সকলকে আইনের দিক থেকে রক্ষা করা সম্ভব৷ সুতরাং ভারতীয় সংবিধান থেকে অবিলম্বে এই ধরনের আইনগত বৈষম্যজনিত মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটিগুলোকে দূরীভূত করা উচিত৷
তৃতীয় মনস্তাত্বিক ত্রুটি হ’ল প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগৎকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষার কোন ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধানে নেই৷ নব্যমানবতাবাদের আদর্শ না থাকায় ব্যাপকভাবে জীবজগৎ ও উদ্ভিদজগৎকে ধবংস করা হচ্ছে, সংবিধানে এদের সুরক্ষারও ব্যবস্থা থাকা উচিত৷ এই ত্রুটি অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন৷
চতুর্থতঃ কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যে সম্পর্ক তা পরিষ্কার বা স্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লিখিত হয়নি৷ এর জন্যে কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে আর তার ফলে মানসিক দিক থেকে গোটাদেশেরই ক্ষতি হতে পারে৷ এ ব্যাপারে দু’টি বিষয় সংবিধানে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল–(১) আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও (২) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে কেউ ইচ্ছা করলে সরে যেতে পারে কিনা৷
পঞ্চমতঃ সংবিধানে উপজাতি ও তপশীলী জাতি সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই৷ জাত–পাতের ভিত্তিতে তপশীলীজাতি বলে খেয়ালখুশীমত চালানো হচ্ছে৷ অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও শিক্ষাগত পশ্চাদ্বর্ত্তিতার ভিত্তিতে কোন পরিবার বা গোষ্ঠীকে উপজাতি বা তপশীলীভুক্ত করা হয়েছে৷