আগামী লোকসভা নির্বাচনে  মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশীয় পুঁজিবাদ  বনাম বিদেশী পুঁজিবাদ

লেখক
 সুকুমার সরকার

গান্ধি-নেহেরুর কংগ্রেস ছিল মিশ্র অর্থনীতির৷ পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ও আধ্যাত্মিকতার মিশেল৷ সে ধারা ইন্দিরা গান্ধি পর্যন্ত বজায় ছিল৷ রাজিব গান্ধির সময় থেকে সেই ধারা বদলাতে  শুরু৷ সাম্যবাদের  জায়গা দখল করে দেশীয় পুঁজিবাদ, আর আধ্যাত্মিকতার জায়গা দখল করে সাম্প্রদায়িকতা৷

শুণ্য দশকে  সে ধারায়  ব্যপকতা লাভ করে  কর্র্পেরেট পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িক পাদ্রি, পুরোহিত, যোগগুরু ও  মোল্লাতন্ত্রের আবির্র্ভব৷ এঁদের তৈরি ধর্মমতের বিধান, যোগশিক্ষার মগজধোলাই ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়েছে৷ এই যোগগুরুদের কেউ কেউ তারস্বরে বিদেশী পণ্য বর্জনের পরামর্শ দিচ্ছেন৷ অনেকেই  পুঁজিবাদীদের পণ্য বিজ্ঞাপনের ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসেডর পর্যন্ত হয়ে উঠছেন৷ এঁরা বিশুদ্ধ ধর্মমত, দেশীয় পণ্য বিজাতীয় সমস্যাগুলিকে খঁুচিয়ে তুলছে৷ এঁদের  মাধ্যমে  বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে দেশীয় পণ্যের সঙ্গে বিদেশীয় পণ্যের৷ এইসব যোগগুরুদের কেউ কেউ  তার স্বরে বিদেশী পণ্য বর্জনের  পরামর্শ পর্যন্ত দিচ্ছেন৷

কিন্তু দেশীয় পুঁজিবাদের চেয়ে বিদেশী পুঁজিবাদ যে আরও বেশী শক্তিশালী! তাই তাদের নজর এড়িয়ে  বাণিজ্য শাসন কখনোই সম্ভব নয়৷ এটা বুঝিয়ে দিতেই  আগামী লোকসভা নির্বাচন তাদের টার্গেট ভিন্নতর পথে হাঁটা৷  সেটা বুঝতে বিশেষ বিশেষজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না৷ একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়৷

আর তাদের লড়াইটা হয় কোনো রাজনৈতিক দল অথবা দলের কোনো ব্যষ্টি বিশেষকে সামনে রেখে৷ একটু খেয়াল করুন, গত লোকসভা নির্বাচনের  অনেক আগে, সম্ভবত ২০০৮ কি ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ হবে৷ টাটাদের ন্যানো কারখানা  পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের  সানন্দায় চলে গিয়েছে৷ সেই উপলক্ষ্যে আহমেদাবাদে এক বণিক সভায় অনিল আম্বানি ঘোষণা করলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে  ভারতের  পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার  যোগ্যতম ব্যষ্টি নরেন্দ্রমোদী৷

তখন হয়তো সেই কথাকে  অনেকে গুরুত্ব দেয়নি৷ কেউ কেউ গুরুত্ব দিলেও  ভাবতে পরেননি যে, যার গায়ে সাম্প্রদায়িকতার রক্ত লেগে  আছে, তাকে ভারতের আম আদমি কী করে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসাবেন৷ কিন্তু অনিল আম্বানিরা যা বললেন তা প্রমাণ করে ছাড়লেন৷

২০১৪-র নির্বাচনে নরেন্দ্রমোদির  বিজেপি বিপুল ভোটে জিতে লোকসভা দখল করলো৷ নরেন্দ্রমোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন৷ নরেন্দ্রমোদীর  প্রতিশ্রুতি  ছিল  উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা৷ কিন্তু ‘‘হা হতোস্মি’’!  কর্মসংস্থান দূর অস্ত উন্নয়ন স্বচ্ছতার ঝাড়ুর আগায়৷ আর বেকার যুবক হতাশ৷ ঋণের দায়ে  কর্ষকেরা  আত্মহত্যার  পথে ৷ কেন্দ্র-রাজ্যগুলির  সম্পর্ক তলানিতে৷ সীমান্ত বহিঃশত্রুর আস্ফালন৷ খুন-জখম-নারীনির্র্যতনে মানুষ দিশেহারা৷ সবমিলে নরেন্দ্র মোদির  উন্নয়নের স্বপ্ণ ফানুস৷

এসব অবশ্য আগেও ছিল , এখনও আছে৷ সরকার বদল হলেও এই একই  অবস্থা থাকবে৷ সেটা কোনো কথা নয়৷  কথা হলো, ওই যারা অলক্ষ্যে থেকে অন্য  কাউকে ক্ষমতায় বসায়৷ কথা তাদের নিয়ে৷ আসল চাবিকাঠি তো তাদের হাতে৷ আসলে কখন কিভাবে কোন চাবি দিয়ে  শোষণের তালা খুলবেন, সেটা ওই পুঁজিপতিরা  ঠিক করেন৷ তাহলে  প্রশ্ণ আসতে পারে, নরেন্দ্রমোদিকে  দিয়ে উন্নয়ন হচ্ছে না বলে কি অন্য কাউকে  আনার চেষ্টা চলছে? না মোটেই  তা নয়৷ দরকার  উন্নয়নের  নামে ধোঁকা দেবার জন্যে নোতুন মুখ৷ সে মুখ তারা আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন৷

গত লোকসভা নির্বাচনে  সে মুখ  ছিল নরেন্দ্রমোদী৷ এবার হতে  পারে সে মুখ  রাহুল গান্ধী বা অন্য কেউ৷  নরেন্দ্রমোদী যতটা দেশীয় পুঁজিপতিদের  মুখপত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন, ততটা বিদেশী পুঁজিপতিদের  মুখপত্র হয়ে উঠতে পারেননি৷  এখানে নরেন্দ্রমোদী বা রাহুল গান্ধী ফ্যাক্টর নয়৷ ফ্যাক্টর শাসনের যন্ত্র সদা সচল রাখতে কাদের ক্ষমতায় বসাতে  হবে সেটা স্থির করা৷  এই ‘তাহারা’ হচ্ছে আসল কথা৷ এরা কখনো  দেশীয় পুঁজিপতি তো কখনো বিদেশীয় পুঁজিপতি৷ নরেন্দ্র মোদী দেশে পুঁজিপতিদের মুখপাত্র৷ রাহুল গান্ধী দেশীয় পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি হবেন৷ আর তাই বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে মূল যে সংঘাত শুরু হয়েছে তা হলো দেশীয় পুঁজিবাদ বনাম বিদেশী পুঁজিবাদ৷ এখন দেখার এ দুইয়ে কার জিত হয়৷

তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এ দুয়ের কোনটাতেই  সাধারণ মানুষের কোনো লাভ নেই ব্যাপারটা দেশীয় মদ বনাম বিদেশী মদের মতো৷ একই নেশা, একই ক্ষতিকারক৷ সুতরাং এ লড়াইয়ে শামিল হয়ে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ নেই৷ মুক্তির পথ খুঁজতে  হবে অন্যপথে৷ আর সে পথের নাম প্রাউট---প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ একমাত্র এই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের মধ্য দিয়েই  সাধারণ  মানুষের  কল্যাণ হতে পারে৷

প্রাউটতত্ত্ব পুঁজিবাদ ঘেঁসা বা পুঁজিবাদ সমর্থিত কোনো তত্ত্ব নয়৷ প্রাউট তত্ত্ব বিশ্বের সকল ভৌমঞ্চলকে ‘‘স্বয়ংসম্পন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল’’ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়৷ সকল মানুষের  আর্থ- সামাজিক-সাংস্তৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে চায়৷ এই তত্ত্বে দেশি বা বিদেশী পুঁজিবাদের লড়াই নেই৷ এই তত্ত্বের কাছে  দেশ বিদেশ বলেও  কোনো  কথা নেই৷ বিশ্বের সকল ভৌমঞ্চল  সকল মানুষের মাতৃভূমি, স্বদেশভূমি, কেননা বিশ্বের  কোনো ভূখণ্ডই কোনো ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷  আমি যদি হাজার কিলোমিটার দূরের কাশ্মীরকে স্বদেশ ভাবতে  পারি, তবে  পঞ্চাশ কিলোমিটার  দূরের বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরকে কেন স্বদেশ ভাবতে পারবো না? প্রাউট এই ধরণের সংকীর্ণ নাগরিক তত্ত্বে বিশ্বাস করে না বলে প্রাউট তত্ত্বে দেশী বিদেশী পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের ব্যাপারটা নেই৷ সুতরাং যেকোনো নির্বাচন  বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আগে সচেতন জনগণকে এই বিষয়গুলি  ভালো করে ভাবতে হবে৷

আজ প্রচারযন্ত্রগুলি যেভাবে পুঁজিবাদীদের বাণিজ্যিক তত্ত্ব প্রচার  করছে সেভাবে প্রাউটের প্রচার  করবে না৷ কেননা প্রচারের এই যন্ত্রগুলি পুঁজিবাদীদের বাহন৷  প্রাউট পুঁজিবাদের কবরখানা৷ সুতরাং পুঁজিবাদী-প্রচারের দুনিয়া কখনোই  প্রাউট তত্ত্বের প্রচার করবে না৷ আর একথাও বলে রাখি, কখনো যদি দেখা যায় পুঁজিবাদীদের প্রচারযন্ত্রে প্রাউটের প্রচার হচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে প্রাউট তার ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে৷ কিন্তু সে আশঙ্কা খুব কম৷ প্রাউট তত্ত্বের অন্তনির্হিত শক্তি সে সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেবে৷ অন্তত আমার বিশ্বাস৷

সুতরাং আজ দেশীয় পুঁজিবাদ বনাম বিদেশী পুঁজিবাদের বিকল্প তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রাউটকে তুলে আনতে হবে৷ ভারতবর্ষের ৪৪ টি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে একসূত্রে গাঁথতে প্রাউট তত্ত্বের বিকল্প নেই৷ সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা খাটে৷