আগুন নিয়ে খেলা ভাল নয়

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

গত নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে দিল্লির উপকন্ঠে প্রায় দেড়মাস ধরে কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে৷ গত ১লা জানুয়ারী তীব্র ঠাণ্ডায় মৃত্যু হ’ল এক কর্ষকের৷ দিল্লি-উত্তর প্রদেশের গাজিপুর সীমানায় মৃত কর্ষক গলন সিং তোমর উত্তর প্রদেশের  মজিদাবাদের বাসিন্দা৷ ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে,তীব্র ঠাণ্ডার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে৷ বয়স সত্তরোধর্ব৷

এর আগে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃত্যু হয়েছে ভীম সিংহ নামে এক আটত্রিশ বছর বয়সের কর্ষকের৷ এ পর্যন্ত এই আন্দোলনে যোগদান কারী ২০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে৷ তবু সরকার কর্ষকদের দাবী মানার কোনো ইঙ্গিতও দেয়নি৷ বহু কর্ষক এই প্রচণ্ড শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন৷ দিল্লির তাপমাত্রা এখন ২ থেকে ৩ ডিগ্রির মধ্যে৷

ভারত কর্ষকপ্রধান দেশ৷ মূলতঃ কর্ষকদের বোটে (ভোটে) জিতেই নরেন্দ্র মোদির সরকার আজ ক্ষমতাসীন৷ যাদের দৌলতে প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রীরা আজ ক্ষমতাসীন সেই হতভাগ্য কর্ষকদের ভুলে মন্ত্রীরা এখন পুঁজিপতিদের স্বার্থসিদ্ধিতেই অনড়৷ সরকার কিন্তু এভাবে আগুন নিয়ে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক খেলা খেলছেন৷

কেননা, এই কৃষি আইন যে মূলত পুঁজিপতিদের স্বার্থেই তা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয় না৷ চাল,ডাল, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ, আলু প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এতদিন মজুত করা আইন বিরুদ্ধ ছিল৷ এই সব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যকে মজুত করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে কৃসি আইনে৷ এটা কাদের স্বার্থে? বড় বড় পুঁজিপতিরা এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ইচ্ছামত মজুত করতে পারবে৷ এরফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হবে ও এই সবের হুহু করে দাম বাড়বে৷  এতে মজুতদারদের লাভের অংক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে৷ আর গরীব মধ্যবিত্তদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকবে না৷ উৎপাদনকারী  কর্ষকদের কিন্তু এতে কোনো লাভ হচ্ছে না৷ তারা তো ফসল ফলার পরপরই  অত্যন্ত কম দামেই তাদের ক্ষেতের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়৷ অভাবের সংসারে তা না করে তাদের কোনো উপায় থাকে না, কারণ এই ফসল বিক্রির টাকা দিয়েই তাদের সংসারের সমস্ত খরচ খরচা যোগাড় করতে হয়৷ এই চাষটাই তো তাদের সম্বল৷ ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে তাদের ফসল উৎপাদনের সাথে সাথে কম দামে কিনে নেয়৷ তারপর হাত বদল হতে থাকে৷ এখন নোতুন আইনে বড় বড় রাঘব বোয়াল পুঁজিপতিরা এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে মজুত করে রেখে দেবে অনির্দিষ্টকাল৷ এজন্যে বিশাল বিশাল হিমঘর বানাচ্ছে তারা৷

প্রশ্ণ উঠতে পারে, এতে সরকারের কী লাভ, তারা কেন পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে কর্ষকদের বিপদে ফেলবে? তার কারণ তো খুব স্পষ্ট৷ ওই সমস্ত বড় বড় পুঁজিপতিরাই তো ক্ষমতাসীন সরকারকে গদীতে বসিয়েছে৷ কেমন করে? নির্বাচনের সময়  দু-হাত ভরে পার্টি ফাণ্ডে টাকা দিয়েছেন, বোটে জেতার জন্যে তো দরকার ভুরি ভুরি টাকা৷ মিডিয়াকে হাতের মুঠোয় রেখে দলীয় প্রচারের জন্যে প্রচুর টাকা দরকার৷ বিশাল ক্যাডার বাহিনী পোষার জন্যে টাকা দরকার, দাঙ্গা বাধিয়ে প্রতিপক্ষকে আতঙ্কগ্রস্ত করার জন্যে বিপুল পরিমাণ টাকার দরকার, নির্বাচনের আগে হরির লুটের মত টাকা ছড়াতে গেলেও লাগবে বিপুল পরিমান টাকা৷ এ সমস্ত টাকার যোগানদার তো পুঁজিপতিরা৷ এছাড়া, নেতামন্ত্রীদের ব্যাঙ্ক -ব্যালান্স বৃদ্ধিও করতে পুঁজিপতিদের দান প্রয়োজন৷ তাই পুঁজিপতিরাই তো নেতা মন্ত্রীদের একমাত্র লক্ষ্মী৷ তাই এই লক্ষ্মী দেবীকে সন্তুষ্ট না রাখলে চলবে কেন!

 

কৃষি আইনে যে চুক্তিচাষের কথা বলা হয়েছে তাতে কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ী, রফতানীকারী ও খাদ্য প্রক্রিয়াকারী সংস্থাগুলি চুক্তির ভিত্তিতে কর্ষকদের দিয়ে সংশ্লিষ্ট ফসল চাষ করিয়ে সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারবে৷ রাজ্যসরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষিপণ্য বাজার  কমিটি নিয়ন্ত্রণে মাণ্ডিগুলিতে ফসল বেচাকেনা করার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না৷

অর্থাৎ সরাসরি রক্তলোভী বাঘের সঙ্গে ছাগশিশুদের চুক্তির ছাড়পত্র দেওয়া হ’ল৷ গরীব, অশিক্ষিত চাষীরা আম্বানী -আদানীদের সঙ্গে চুক্তির জালে জড়িয়ে প্রথমটা কিছু সুযোগ সুবিধা বা বাড়তি অর্থের মুখ দেখলেও পরবর্ত্তীকালে যে চাষীরা মুনাফাবাজ হাঙরদের দ্বারা চরমভাবে শোষিত হবে না, তার গ্যারান্টী কই?

চুক্তির শিকলে আবদ্ধ হয়ে চাষীরা যে ধীরে ধীরে পুঁজিপতিদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে না তার গ্যারান্টী কই? ব্রিটিশ আমলে নীলচাষের অভিজ্ঞতা ভারতবাসী ভুলে যায়নি৷

ফসলের কোয়ালিটি ঠিক নেই এই বলেই তো চাষীদের ঠিক ঠিক দাম না দেওয়াও হতে পারে৷ তারপর কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে৷ গরীব গ্রামের চাষীরা কি আম্বানী-আদানিদের মত পুঁজিপতিদের কাছ থেকে তাদের ন্যায্য দাবী আদায় করতে পারবে? যদিও তৃতীয় কৃষি আইনে কর্ষকদের চুক্তিচাষে সুরক্ষা ও ফসলের মূল্য নির্ধারণের জন্যে সরকার ব্যবস্থা নেবে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কিন্তু তার ওপর কেউ ভরসা করতে পারছে না৷

এই পুঁজিপতিরা তো হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের কর ফাঁকি দিয়ে সরকারকে নাস্তানাবুদ করছে, কোটি কোটি টাকা বিদেশের  ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখছে, প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে মস্তি ওড়াচ্ছে৷ তাছাড়া, পুঁজিপতিদের টাকার কাছে তো অধিকাংশ নেতা-মন্ত্রী ও আমলাদের মাথাও বিক্রি হয়ে গেছে৷ এ অবস্থায় চাষীদের ভরসা কী?

সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশিত একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি৷ পুঁজিপতিদের কাছে সরাসরি ফসল বিক্রি করতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশের  শ-দেড়েক চাষীর প্রতারিত হওয়ার ঘটনা৷ যদ্যাপি মধ্যপ্রদেশ বিজেপি শাসিত৷ ওই চাষীরা সরকারী (রাজ্য) মাণ্ডির বাইরে নিজেদের পছন্দমতো বেসরকারী সংস্থার কাছে ফসল বিক্রি করেছিল৷ কিন্তু পরে দেখা যায় ওই সংস্থা ভুয়ো৷ ফসলের দাম বাবদ যে টাকা চাষীরা পেয়েছে তাও অকেজো৷ ঘটনাটি ঘটেছে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ও কৃষিমন্ত্রী কমল প্যাটেলের নিজের জেলায়৷

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের অনুসরণে মধ্যপ্রদেশ সরকার সরকারী মাণ্ডির বাইরে থেকে ফসল কেনার নিয়ম অনেক শিথিল করেছিল৷ তারপরই এই ঘটনা৷ চাষীরা ওই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন৷ কিন্তু কবে এর ফয়সালা হবে কে জানে! গরীব চাষীদের তো দুর্দশার অন্ত থাকবে না৷

প্রধানমন্ত্রী মোদিজী সব সময় ‘আত্মনির্ভরতা’র শ্লোগান দেন৷‘কিন্তু তাঁদের কৃষি আইনে চাষীরা যাতে আত্মনির্ভর হতে পারে, স্বাধীনভাবে চাষ করে সত্যিকারের উন্নতি করতে পারে, ফসলের ন্যায্য দাম পায় ---সে ব্যবস্থা তো নেই! তাদের তো পুঁজিপতি-নির্ভর করা হচ্ছে!

কৃষি প্রধান ভারতে কর্ষকদের ‘আত্মনির্ভর’করতে হলে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত ‘প্রাউটে’র বিকেন্দ্রিত অর্থনীতিই গ্রহণ করতে হবে৷ কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে, কৃষিক্ষেত্রে সারা বছর সেচের জলের ব্যবস্থা করতে হবে, কৃষি সমবায় চালু করতে হবে৷...

যদি সত্যি চাষীদের কিছুমাত্র উন্নতি চান তাহলে প্রাউটের  যুগান্তকারী কৃষিনীতি বিশদভাবে জানুন ও তাকে বাস্তবায়িত করুন৷ এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই৷

এখন সরকার যদি যুক্তি বিবেকের পথ না মাড়িয়ে নিজের জিদ্‌কে বজায় রাখারই চেষ্টা চালিয়ে যান্‌ ও জনগণের স্বার্থ ভুলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে অনড় থাকতে থাকতে চান, তাহলে কিন্তু মস্ত ভুল করবেন৷ আগুন নিয়ে বেশি খেলা ভাল নয়৷