২০২০-এর অন্তিমলগ্ণে দেখছি রাজ্য রাজনীতিতে দলবদলের হিড়িক পড়ে গেছে৷ এ রাজ্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিভিন্ন দল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে দলবদল করে আসার একটা প্রবণতা দেখা গিয়েছিল৷ এখন বিজেপি দলে ঢোকার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে৷ গত কয়েকদিন আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হেভিওয়েট নেতা শুভেন্দু অধিকারী যিনি তিন তিনটে বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন, যাঁকে এক সময় মনে করা হ’ত মমতার পরই এঁর স্থান তিনিও বিজেপি-তে নাম লেখালেন৷ একই দিনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের ৯জন বিধায়ক, ১জন সাংসদ ও একজন প্রাক্তন মন্ত্রীকেও বিজেপিতে নিয়ে এলেন৷ অন্যদিকে আদর্শগত দিক থেকে যে সব দলের স্থান একেবারে বিপরীত মেরুতে সেই সিপিএম ও সিপিআই দলের যথাক্রমে তাপসী মণ্ডল ও অশোক দিন্দা, তাঁদের সঙ্গে কংগ্রেসের সুদীপ মুখোপাধ্যায় বিজেপিতে নাম লেখালেন৷
এতদিন যাঁরা বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাত-পাত ভেদ প্রভৃতি নীতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, এখন তাঁরা কীভাবে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করলেন, তা ভেবে অনেকেই বিস্ময়বোধ করছেন৷
রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এঁদের মনে ধারণা জন্মেছে, যে বিজেপি’ই এবার রাজ্যের ক্ষমতা দখল করবে৷ আর তাহলে তাঁরা ক্ষমতার স্বাদ আরও ভাল করে পাবার সুযোগ পাবেন৷ এই ভেবেই দলত্যাগ৷ অনুমান বিভিন্ন মানুষের যাই হোক, কিন্তু তাহলে এতদিনের ঘোষিত আদর্শের কী হবে? সে চিন্তা তাঁরা করছেন না৷ এর থেকে বোঝা যায় প্রচলিত গণতন্ত্রে আদর্শ ব্যাপারটা নিতান্তই গৌণ৷ এখানে ক্ষমতা-দখলটাই আসল কথা৷
কেবল সাম্প্রতিক দলবদলেই নয় প্রচলিত গণতন্ত্রে বিভিন্ন বিভিন্ন দলের নেতাদের প্রায় সমস্ত কার্যকলাপই এই একই রায় দিচ্ছে৷ কর্র্ণটক রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক রাজ্যনির্বাচন ও সরকার তৈরীর নাটকও তো সেই কথা বলে!
ছলে বলে কৌশলে ,অর্থবলে, পেশীশক্তির জোরে এখন যেন তেন প্রকারেণ শাসন ক্ষমতা দখল করা চাই৷ এটাই প্রচলিত গণতন্ত্রের সারকথা৷
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এককালে রাজতন্ত্রের শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে গণতন্ত্রের প্রবর্ত্তন করা হয়েছিল৷ গণতন্ত্রের লক্ষ্য ছিল জনগণের সেবা, যাঁরা যথার্থ নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব নিয়ে সমাজ পরিচালনা করবেন তাঁদের হাতে সমাজের পরিচালনভার তুলে দেওয়া৷ তাঁদের একটা মহান্ আদর্শ থাকবে৷ তাঁরা দৃঢ়ভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হবেন৷ আদর্শ ও নীতিবাদ থেকে কখনও কোনো অবস্থাতে তাঁরা বিচ্যুত হবেন না৷ তাই তাঁদের ওপর বিশ্বাস করা যাবে, তাঁরাই প্রকৃত জনপ্রতিনিধি, তাই জনগণের যথার্থ কল্যাণার্থে তাঁদের ওপর বিশ্বাস করেই শাসনভার তাঁদের হাতে অর্পন করা যায়৷
কিন্তু আজ গণতন্ত্রের সে রূপই নেই৷ গণতন্ত্র আজ ক্ষমতাপিপাসুদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে৷ তার সঙ্গে জুটেছে ধনকুবেরদের টাকার বস্তার প্রলোভন৷ গণতন্ত্রের ক্ষমতা দখলের ময়দানে নেমে যে যত পার নিজেদের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স বাড়াও ও পার্টিফাণ্ড বাড়িয়ে জনমত কিনে নাও৷ বর্তমানে এমনি অবস্থা যে দুনিয়া টাকার বশ! কারণ নীতিবাদ ও আদর্শবাদ তো প্রায় উধাও৷ যাদের মধ্যে গভীর নীতি ও আদর্শবাদ রয়েছে--- গণতন্ত্রের লড়াইয়ের ময়দানে তারা ব্রাত্য৷ আজ এটাই চলেছে প্রায় সর্বত্রই৷
এটাই কি তাহলে চলবে? এই মিথ্যার গোলক ধাঁধা থেকে কি মুক্তির কোনো রাস্তা নেই? নেই এমন হতে পারে না৷ মিথ্যার রাজত্ব, অন্ধকারের রাজত্ব দীর্ঘদিন চলতে পারে না৷ আসলে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অন্ধকার বলে কিছু নেই৷ আলোর অভাবকেই বলে অন্ধকার৷ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে এই অনাচার চলছে৷ জনমনে জ্ঞানের আলো জ্বললেই অন্ধকার দূরে পালাবে আর অন্ধকারের জীবেরা--- অন্ধকারের সুযোগে যারা মানুষকে ঠকাচ্ছে--- তারাও আর তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে না৷
এখন সে আলো কী? আর কোথায়? ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখেছি,অর্থনীতিকে বন্ধন মুক্ত করার জন্যে এ্যাডাম স্মিথ ---‘Laisser-faire’’ তত্ত্ব দিলেন যাতে অর্থনীতির অবাধ স্বাধীনতার দাবী করলেন৷ তা থেকে জন্ম নিল ধনতন্ত্রবাদ৷ এই ধনতন্ত্রবাদ জন্ম দিল পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থা৷ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সমাজের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয় পুঁজিপতিদের জিম্মায় চরম দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা চরমভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ এই শোষণ থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্যে কালমার্ক্স দিলেন তার কম্যুনিজম তত্ত্ব, যা মার্ক্সবাদ নামেই পরিচিতি৷ কিন্তু জড়বাদ আধারিত মার্ক্সবাদও জনগণের শোষণমুক্তির রাস্তা দেখাতে পারলো না৷ তাও একনায়কতন্ত্রের রূপ নিল৷ তাই জনগণ তাকেও প্রত্যাখ্যান করল৷
মানুষ আর পথ পাচ্ছে না৷ এই অবস্থায় মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার দিয়েছেন ‘প্রাউট’ দর্শন--- যেখানে তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি সহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রকার শোষণমুক্তির যথার্থ পথ দেখিয়েছেন৷ কী সেই পথ?---অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি দেখিয়েছেন যথার্থ অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের পথ৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায়৷ গণতন্ত্রের প্রথম কথা হ’ল প্রতিটি মানুষেরই যুগোপযোগ ন্যূনতম চাহিদাপূরণের গ্যারান্টী অর্থাৎ যুগোপযোগী পুষ্টিকর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থা আর তার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মানুষের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্থাৎ অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষমতা৷
সামাজিক ক্ষেত্রে ঘোষণা---মানবসমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ জাত-পাত-সম্প্রদায়ের ভেদরেখা টেনে মানবসমাজকে খণ্ডিত করা চলবে না৷ মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই৷ শুধু মানুষ কেন মানবতার মাধুর্য্যকে সমস্ত পশুপক্ষী তরুলতার মধ্যে প্রসারিত করে প্রাউট বিশ্বমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠার কথা বলে৷
শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাউট বলে ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’--- সেইটাই বিদ্যা শিক্ষা যা জাগতিক,মানসিক ও আধ্যাত্মিক তিনস্তরেই সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ দেখাবে৷
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাউটের ঘোষনা মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেবল তাদেরই কর দেওয়া হবে যারা দৃঢ়ভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত, সমস্ত প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে যিনি সর্বদা সংগ্রামে প্রস্তুত, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ও সেবাব্রতী, প্রাউট-প্রবক্তার ভাষায় তাদের বলা হবে ‘সদ্বিপ্র’৷
এইভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই সর্বাত্মক শোষণমুক্ত, ‘ভূমা উত্তরাধিকার’তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ গড়াই প্রাউটের লক্ষ্য৷ ‘পুরাতন বৎসরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি’র অবসান ঘটেছে এবার নোতুন বৎসরের যাত্রা শুরু৷ ২০২১-এর নববর্ষের পূণ্যদিনে আমি আজ সবার প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রাউট-প্রবক্তার ভাষাতেই সবাইকে আহ্বান জানিয়ে তাঁর আশিষবাণী শোনাই ---‘‘মানবসভ্যতা আজ এক যুগসন্ধির চরম মুহূর্তে এসে পৌঁচেছে, এর একদিকে রয়েছে পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কাল, অন্যদিকে নোতুন জীবনের রক্তিম ঊষা৷ মানুষকে এ দুয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে৷ আমি তোমাদের বলব এই আলোকস্নাত নূতন ঊষাকে বরণ করে নাও৷ জয় তোমাদেরই হবে৷’’ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি
- Log in to post comments