আজ এই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের কর্তব্য

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্তমান যুগে কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, কি সাংসৃক্তিক, কি মানসাধ্যাত্মিক – সর্বক্ষেত্রেই দেখা দিয়েছে দারুণ বিপর্যয়৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এক সঙ্গে এগিয়ে চলার নাম সমাজ৷ (সমানম্ এজতি ইতি সমাজঃ)৷ কিন্তু  আজ এই সহযোগিতার ভাব, এই সহমর্মিতার ভাবের সম্পূর্ণ অভাব৷ আজ জাত–পাত–সম্প্রদায় প্রভৃতি নানান সংকীর্ণতা, পারস্পরিক বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক লড়াই মানব সমাজকে ধ্বংসের অতল গহ্বরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় মানুষের বিপুল ঐশ্বর্য ও চরম বিলাসিতার পাশাপাশি বিরাজ করছে চরম অভাব–দারিদ্র্য, যদিও বিশ্বের সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক বিশ্বস্রষ্টা, আর বিশ্বের সবাই তাঁরই সন্তান৷ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অযোগ্য নেতৃত্বের সমস্যা সর্বত্র চরমভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে৷ সাংসৃক্তিক ক্ষেত্রে চলছে সর্বত্র অসংস্কৃতির বেলাল্লাপনা৷ মানসাধ্যাত্মিক স্তরে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে কোথায় দেবত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা না করে তার পরিবর্তে মানুষ ধীরে ধীরে পশুত্বের অন্ধতমিস্রার অভিমুখেই পিছিয়ে চলেছে৷

এক কথায় মানুষ চরম ভাবে দিশাহারা৷ তার ফলেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার, শোষণ ক্রমবর্দ্ধমান৷ সমস্ত চিন্তাশীল মানুষেরা, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা, যাঁরা সমাজে কল্যাণের কথা ভাবেন, তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না, সমাজের এই চরম দুরবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী?

ঠিক এই অবস্থায় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভূত হয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরলেন মানব জীবনের সর্বাত্মক আদর্শের পথ৷ তিনি প্রথমেই কম্বুকন্ঠে ঘোষণা করলেন, সমস্ত পশু–পক্ষী সহ সমস্ত প্রাণীর জীবনধর্ম বা জৈবধর্ম হ’ল আহার, নিদ্রা, ভয় ও সংখ্যাবৃদ্ধি করা, কিন্তু মানুষের বৈশিষ্ট্য তার ভাগবত ধর্মে৷ অর্থাৎ মানুষের মধ্যে বৃহতের এষণা রয়েছে – অর্থাৎ মানুষ অসীমকে পেতে চায়৷ এই বৃহৎ বা অসীম একমাত্র ভগবান তথা পরমব্রহ্ম৷ সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রের পানে ছুটে চলেছে, তেমনি সমস্ত মানুষের জীবনের গতি ঈশ্বরের দিকে৷ তাই মানুষ অন্তর্জগতে ঈশ্বরলাভের সাধনা করবে৷ আর, বাইরের জগতে, বিশ্বের সমস্ত মানুষ, এমনকি পশু–পক্ষী–উদ্ভিদও ঈশ্বরের বিকাশ, সবার মধ্যে ঈশ্বর রয়েছেন–তাই সমস্ত মানুষের তথা জীবের সেবাই মানুষের আদর্শ৷

এই ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ – আত্মমুক্তি ও জগতের কল্যাণ–সাধনের আদর্শ নিয়ে মানুষকে চলতে হবে৷ যে মানুষ জীবনের এই মহান আদর্শকে অস্বীকার করে’ উল্টো পথে চলতে চায় বুঝতে হবে সে পশুত্বের পথে চলছে৷

মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশের মধ্যেই রয়েছে মানুষের সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধানের মূল চাবিকাঠি, আর এই পথ হ’ল এই ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’–এর পথ৷ মানসাধ্যাত্মিক স্তরে একমাত্র এই শিক্ষাই মানব সমাজকে রক্ষা করতে পারে৷

সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করলেন, সমস্ত মানুষ যেহেতু পরমব্রহ্ম তথা পরমেশ্বরের সন্তান, তাই মানুষের মধ্যে কোনো জাত–পাত, সম্প্রদায়ের ভেদ থাকা উচিত নয়৷ মানব সমাজ এক ও অভিভাজ্য৷ সকল মানুষের এক জাতি – মানব জাতি এক সম্প্রদায় – মানব সম্প্রদায়৷ সকল মানুষের ধর্মও এক – মানব ধর্ম৷ ঈশ্বরও এক – ব্রহ্ম৷ আল্লা, গড্ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় একই ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম মাত্র৷

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) মানব সমাজকে ‘প্রাউট’ তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন – যার মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছেন৷ পুঁজিবাদ নয়, মার্কসবাদও নয়– একমাত্র প্রাউটই সর্বাত্মক শোষণমুক্ত ও প্রকৃত প্রগতিশীল সমাজ রচনার পথ৷ একমাত্র এর মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গারান্টী ও যুগোপযোগী ক্রয়ক্ষমতার ক্রমোন্নতি সম্ভব৷

ঠিক তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রাউট–প্রবক্তা আজকের নেতৃত্বের সংকটের অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত নীতিবাদীদের নেতৃত্বে মাধ্যমে রাজনীতিকে প্রকৃত অর্থে কীভাবে জীবসেবার নীতিতে পরিণত করা যায় তার পথ দেখিয়েছেন তাঁর ‘সদ্বিপ্র সমাজ’ তত্ত্বের মাধ্যমে৷

শিল্প–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আজকের যুগের যে চরম অবক্ষয় তার প্রধান কারণ হ’ল, শিল্প–কলা সম্পর্কে আজকের চিন্তাধারা ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ (শিল্পের জন্যেই শিল্প)৷ এই ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি সুস্পষ্ট রূপে ঘোষণা করেছেন – ‘আর্ট ফর সার্ভিস এ্যান্ড ব্লেসেডনেস্’ (সেবা ও কল্যাণের জন্যেই শিল্প–কলা)৷ তিনি তাঁর শিশুসাহিত্য, গল্প, নাটক, গান (প্রভাত সঙ্গীত) প্রভৃতির মাধ্যমে এই আদর্শকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷

এই ভাবে মানবসমাজের আজ যা কিছু অনুপপত্তি তথা অভাব সমস্ত কিছুর অবসান ঘটিয়ে – এক পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ মানবসমাজকে উপহার দিয়েছেন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷

সঙ্গে সঙ্গে এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এক বিশ্বব্যাপী সংঘটন তৈরী করে তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামীকে আদর্শ মানব সমাজ রচনার গুরুদায়িত্ব দিয়ে গেছেন তিনি৷

আসুন, বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ – সমস্ত আদর্শবাদী মানুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই মহান আদর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানুন৷ মানব জীবনকে সার্থক করতে তথা আদর্শ সমাজ সংরচনা করতে– এই সুমহান আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসুন৷