হবে নাইবা কেন ? খিদে পেয়েছে খাবার নেই ? টাকা ফেল -- খাবার চলে আসবে। শীত লাগছে,শীতের কাপড় নেই ? টাকা দিলেই চলে আসবে। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই ? রোগের ওষুধ নেই? ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া শেখানোর ক্ষমতা নেই ? টাকা থাকলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সমাজে ভাল মন্দ এমন কোন কাজ নেই যা কিনা অর্থ দিয়ে হয়না। অবশ্য টাকা দিয়ে একমাত্র ভক্তি-ভালবাসা পাওয়া যায়না,স্থায়ীসুখ বা আনন্দ ( সুখম্ অনন্তম্ আনন্দম্ )কেনা যায়না। এর থেকে একটা কথা পরিষ্কার যে অর্থ বা টাকা থাকলে জাগতিক তথা শারীরিক প্রয়োজনের অভাব ও অভাব জনিত দুঃখ দূর করা যায়। তথাপি এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার -- জাগতিক অভাবটা ও অভাব জনিত দুঃখটা পৌনঃপুনিক, আবৃত্ত দশমিকের মতন আসে যায়। একবার খাবার পেয়ে বা টাকা পেয়ে খাবার কিনে খেয়ে খিদের জ্বালা -দুঃখ চিরকালের মত মিটল -- তা তো নয়। মানুষ যতদিন বাঁচবে ততদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর খিদে পাবে, খেতেও হবে। আর এজন্যে সরাসরি খাদ্য বা তা পাওয়ার স্থায়ী মাধ্যম অর্থাৎ টাকার যোগানের স্থায়ী ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রেও একই কথা । তাই ভিক্ষে বা দান দিয়ে এটা মেটান যায়না; স্ব-ক্ষমতায় আয়ের স্থায়ী উৎস চাই-ই চাই। লোক বাঙলায় তো একটা কথাই আছে ---’বাইরে থেকে উজার(উপুর)করে ঢেলে(দিয়ে) কারো ফাঁড় ভরানো যায়না। গতর খাটিয়ে পাকাপাকি রোজকার রোজগার চাই।’ সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য একথাও মনে রাখা দরকার -- টাকা নিজে অভাব বা দুঃখ দূর করতে পারেনা , অর্থের বিনিময়ে পাওয়া সামগ্রী ও পরিষেবাই তা পারে। ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায় যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঊৎপাদিত দ্রব্যের উপযোগিতা বা করণশক্তির যোগ ছাড়া টাকার কোন মূল্য নেই। যদি এমনটা হয় --- বস্তা বস্তা টাকা আছে, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কেনার কোন জিনিস নেই, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবেনা , তাহলে টাকার কি দাম থাকল ! টাকা ধুয়ে তো আর মানুষ জল খাবেনা ! আসল কথাটা হল --অভাব মোচনের দ্রব্যেসামগ্রীর পর্যাপ্ত উৎপাদন ও যোগান । --- অর্থ বা টাকা বিশেষ সময়ের কিছু শর্তাধীনে দ্রব্য বা সেবা মূল্যের প্রতীকী আরোপিত মূল্যরূপ মাত্র। তবে একথাও ঠিক--- প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগানের হ্রাস-বৃদ্ধিতে বা উৎপাদনের কম বেশীতে, সময় বিশেষে পরিস্থিতি অনুযায়ী টাকার মূল্য ওঠা নামা করে; আন্তর্জাতিক বাজারেও বিভিন্ন দেশের টাকার মধ্য পারস্পরিক বিনিময় মূল্যও এক নয়, তেমনি তা ওঠা নামাও করে। এই কারনে বিশ্বে সর্বত্র ছাপান টকায় মূল্য আরোপ করতে, সেইমূল্যকে স্থিতিশীল রাখতে, দেশের ভিতর ও আন্তর্জাতিক স্তরে মুদ্রা মান ও মূল্যের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে 'বিত্তকোষ’রূপে স্বর্নভাণ্ডার (বুলিয়ন ) গড়া হয়। বিত্তকোষ জমার ভিত্তিতে সমমূল্যের পরিমানে টাকা ছাপান হয়। এমনকি সরকারের ঋণ গ্রহনের ক্ষেত্রেও বিত্তকোষের মত খাদ্য ভাণ্ডার মজুত থাকে । এই ব্যবস্থা না-থাকলে অর্থের বাজারে ধস নামে, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সোনা পৃথিবীর সব জায়গাতেই বিনিময় যোগ্য।সহজ কথাটা হল--সোনার বহুমুখী উপযোগিতা - উজ্জ্বলতা-নমনীয়তা-সৌন্দর্য্য-দুষ্প্রাপ্যতার কারণে সবদেশেই সোনার কদর । মানুষ অভিজ্ঞতায় দেখেছে---একটা দুটো স্থানে বা দেশে উৎপাদন মার খেলে, জিনিস অমিল হলেও পৃথিবীর সর্বত্র একসঙ্গে উৎপাদন পুরোপুরি মার খায়না বা অমিল হয়না। সোনা থাকলে বিনিময়ে পৃথিবীর যে কোন স্থান বা দেশ থেকে জিনিস পাওয়া যাবে।
আসল কথাটা হল সোনার মতই দ্রব্যের স্ব-মূল্য বা উপযোগিতা। উপযোগিতাই ( কাজে লাগা গুণ) দ্রব্যেকে মূল্যবান করে । সাধারণ ভাবে ধূ ধূ মরুভূমির বুকে 'বালি’কোন কাজে লাগে না। তাই সেখানে বালির কোন মূল্য নেই। আবার সেই মরুভূমির বুকে যখন নির্মাণকার্য চলে তখন ওই বালি-ই হয় কাজের, আর তাতেই মূল্য-হারা বলি মূল্যবান হয়ে ওঠে। যার নামী ব্যাণ্ডের অনেক দামী জুতো আছে, তার কাছে ছেঁড়া জুতোটা মূল্যহীন বর্জ্য পদার্থ মাত্র; কিন্তু আকাশ থেকে আগুন ঝরা গ্রীষ্মের দুপুরে উত্তপ্ত পীচের রাস্তায় ভিক্ষায় চলা ভিখারীর কাছে ওই ছেঁড়া জুতোটাই মহার্ঘ্য বস্তু । কেননা দাবদাহের রোষতপ্ত রাস্তার আক্রোশ থেকে ভিখারীর পাদুটোকে রক্ষা করবে।বস্তুতঃ উপযোগিতাই ( জীবের অভাব মোচনে যা কাজে লাগে বা ব্যবহার করা যায় এমন ) কোন দ্রব্য বা জিনিসের স্ব-মূল্য; দ্রব্যের স্ব-মুল্যেই তার অর্থমূল্য। জানা দরকার, জগতে এমন কোন জিনিস নেই - যার কোন উপযোগিতা নেই। এসব থেকে একটা কথা বলা যায় যে যেকোন দ্রব্যের শেষ বিন্দু পর্যন্ত বা একাবারে শেষ নাহওয়া পর্যন্ত উপযোগ গ্রহণ করাই সমাজশাস্ত্র সম্মত। প্রকৃতি থেকে আমরা তো সে শিক্ষা নিতেই পারি। --- পেট পুরে খেয়ে জলের কুমির চড়ায় এসে চোখ বুঁজে মুখটা হাঁ করে রোদ পোহাতে লাগল। পাখিরা পাশেই এই অপেক্ষাতেই ছিল। সোজা কুমীরের হাঁ-এর মধ্যে ঢুকে দাঁতের ফাঁক থেকে মাংসের টুকরোগুলো ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগল। পাখি বোঝে যে কুমীর হাঁ বন্ধ করবেনা ,কারণ পাখি এও জানে যে এত কুমীরের দাঁত পরিষ্কার হচ্ছে, কুমীর আরাম পাচ্ছে। তাহলে সমীকরণটা কী হল না পাখি পাচ্ছে খাদ্য, আর কুমীর পাচ্ছে দাঁতের কষ্ট মুক্তির পরিষেবা। শ্বাপদ সঙ্কুল বনজঙ্গলের আরেকটি সাধারণ দৃশ্য --- বাঘ-সিংহ কোন শিকার ধরে খেয়ে দেয়ে চলে গেল। পাশেই ওঁৎ পেতে বসে ছিল শেয়াল, নেকড়ে ও হায়নার মত মাংসাশী কিছু প্রাণী; এবার ছুটে এসে অবশিষ্ট যা পড়েছিল তা খেয়ে দেয়ে জিভে-মুখে চক্চক্ করতে করতে চলে গেল। সামান্যতম অপচয়ও কিছুতেই নয়। সব কিছুরই উওযোগিতা আছে। জীবের মঙ্গলে জগতের কল্যাণে প্রতিটি দ্রব্যের একশত ভাগেরই উপযোগ নিতে হবে। শুধু বস্তুপুঞ্জের ক্ষেত্রে নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। ষাট ঊর্দ্ধ একটি মানুষ কর্মজীবন থেকে অবসর নিল মানেই কী নিষ্কর্মিক অলস জীবন ! দিনগত পাপক্ষয় ! ‘কন্ডেম্ড্ সেলে’বাতিলের খাতায় চলে গেল ! একেবারে অক্ষম নাহলে আমৃত্যু তাঁর বিদ্যা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার তো একটা মূল্য আছে। কাজের মধ্যে থেকে তাঁরাও তো আনন্দময় জীবন কাটাতে পারেন। তাছাড়া সমগ্র মানবসম্পদেরই পরিকল্পনা মাফিক সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযোগিতা নেওয়ার ও সার্বিক অভাব মোচনের দায়বদ্ধতার জন্যই না সমাজ ! উদ্ভিদজগৎও তার বর্জ্য ঝরাপাতা মাটিতে পড়ে পচে সারে পরিণত হলে, তার থেকে খাদ্যপ্রাণ রূপ উপযোগিতা গ্রহণ করে, অস্তিত্ব রক্ষা -বৃদ্ধি-বিকাশে দড় হয়।।আরো স্মরনীয় বিষয় হল --- কোন অভাব দূর করতে মানুষের জানা পরিচিত নিত্য বা সচরাচর ব্যবহার্য দ্রব্যের বাইরে না-জানা অনেক বিকল্প দ্রব্যই প্রকৃতিতে পাওয়া যেতে পারে, নতুবা বিজ্ঞান বলে তৈরীও করা যেতে পারে -- যা ওই একই ধরণের অভাব দূর করতে পারে। জাগতিক দুঃখ বা অভাব দূর করতে দ্রব্যের উপযোগিতা সন্ধান করে তা ব্যবহার করাই বড় কথা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার । মানুষের জাগতিক দুঃখ -অভাব-এর অন্যতম মূল কারণই বোধ হয় মানুষকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপযোগিতা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত ও অবদমিত করা এবং এখনও বিজ্ঞানের যুগে বাস করেও বিকল্প দ্রব্যের উপযোগিতা গ্রহণ করতে না-পারা। এর থেকেই আধুনিক অর্থনীতিতে’উপযোগ তত্ত্বে্র’উদ্ভব।---এর স্বভাবটা ---সিম্বায়োটিক, প্রগতিশীল, স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী মানিয়ে চলা যোগ্য,পরিধি বিশ্ব জুড়ে, অভিগম প্রতিভাসিক ও অতিন্দ্রীয় জগতের অস্তিত্বের কণায় কণায়।। (ক্রমশঃ )
- Log in to post comments